
ওঙ্কার ডেস্ক : “নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেল চলবে না”, আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে ‘সংঘর্ষ বিরতি’কে স্বস্তির জায়গায় রাখতে দিলেন না মোদী। তাঁর সাফ কথা “রক্ত আর জল এক সঙ্গে বইতে পারে না”। সন্ত্রাসবাদ দমনে তিনদিনের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভারত তার অবস্থান সম্পর্কে বিশ্বকে যে বার্তা দিয়েছে সেটাই বুঝিয়ে দিলেন মোদী। ভারত-পাক সংঘর্ষের শর্ত সাপেক্ষ বিরতির পর সোমবার রাত ৮টায় জাতির উদ্দেশে তাই মোদী ছিলেন চরম আত্মবিশ্বাসী। বক্তব্যে ছিল নরম গরম-এর ভারসাম্য আর ইঙ্গিতপূর্ণ।
এর আগে এদিন দুপুরে নিজের বাসভবনে বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, তিন সেনা প্রধান, বিদেশ সচিবদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করেন তিনি। এরপরই হয় ভারত ও পাকিস্তান দু দেশের ডিজিএমও-এর মধ্যে অনলাইন বৈঠক। ‘অপারেশন সিদুঁর’ নিয়ে দিনভর একেরপর এক আলোচনার পর অবশেষে এদিন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। দ্ব্যার্থহীন ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দেন জঙ্গিদমনে ভারতের কঠোর অবস্থানের কথা।
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক দিনগুলিতে সমগ্র জাতি ভারতের শক্তি এবং সংযম উভয়ই প্রত্যক্ষ করেছেন”। প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে দেশের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের তিনি অভিনন্দন জানান। ‘অপারেশন সিন্দুরে’র লক্ষ্য অর্জনে ভারতের সাহসী সৈন্যদের অটল সাহসের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। স্বীকৃতি দেন- তাদের বীরত্ব, স্থিতিস্থাপকতা এবং অদম্য মনোবলকে। তিনি এই অতুলনীয় সাহসিকতা জাতির প্রতিটি মা, বোন এবং কন্যার প্রতি উৎসর্গ করেন।
২২শে এপ্রিল পাহেলগামে বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনাকে সন্ত্রাসের এক ভয়াবহ প্রদর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “ছুটি কাটাতে থাকা নিরীহ নাগরিকদের তাঁদের পরিবার এবং শিশুদের সামনেই তাদের ধর্মীয় বৈরতা এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এটি কেবল নিষ্ঠুরতার কাজ নয়, বরং জাতির সম্প্রীতি ভেঙে ফেলার একটি জঘন্য প্রচেষ্টা”। এই হামলার প্রতি গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি তুলে ধরেন, কী ভাবে সমগ্র জাতি, প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি সম্প্রদায়, সমাজের প্রতিটি অংশ এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দল- সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে”। তিনি সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠনকে সতর্ক করে ঘোষণা করেন, তারা এখন দেশের নারীদের মর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টার পরিণতি পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে।
তিনি বলেন, “অপারেশন সিঁদুর কেবল একটি নাম নয় বরং লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের আবেগের প্রতিফলন”। প্রধানমন্ত্রী একে ন্যায়বিচারের প্রতি একটি অটল অঙ্গীকার হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা বিশ্ব ৬-৭ মে পূর্ণ হতে দেখেছে। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদীদের আস্তানা এবং প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে। তিনি বলেন, “সন্ত্রাসবাদীরা কখনও কল্পনাও করেনি যে ভারত এত সাহসী পদক্ষেপ নেবে”। তাঁর ভাষণে একথাই স্পষ্ট হয় যে যখন জাতি তার পথপ্রদর্শক নীতি হিসাবে নেশন ফার্স্টের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকে, তখন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং প্রভাবশালী ফলাফল পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “পাক সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিতে ভারতীয় সেনা শুধু ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা করেনি, তাদের মনোবলও ভেঙে দিয়েছে।“
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এও উল্লেখ করেছেন, বাহাওয়ালপুর এবং মুরিদকের মতো স্থানগুলি দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে আসছিল, যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার ৯/১১ হামলা, লন্ডন টিউব বোমা হামলা এবং ভারতে কয়েক দশক ধরে চলে আসা সন্ত্রাসবাদী হামলা। তিনি ঘোষণা করেছেন, যেহেতু সন্ত্রাসবাদীরা ভারতীয় মহিলাদের মর্যাদা নষ্ট করার সাহস দেখিয়েছিল, তাই ভারত সন্ত্রাসের মূল কেন্দ্রগুলি ধ্বংস করেছে। এই অভিযানের ফলে ১০০ জনেরও বেশি বিপজ্জনক জঙ্গি নিহত হয়েছে, যারা কয়েক দশক ধরে ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র করে আসছিল।
মোদী বলেন, “ভারতের সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী প্রত্যাঘাত পাকিস্তানকে গভীর হতাশায় ফেলেছে”। তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ে যোগদানের পরিবর্তে তারা ভারতীয় স্কুল, কলেজ, গুরুদ্বার, মন্দির এবং সাধারণ নাগরিকদের বাড়িতে হামলা করেছে। এদিন তাঁর ভাষণে তিনি তুলে ধরেন, এই আগ্রাসন কীভাবে পাকিস্তানের দুর্বলতাগুলিকে উন্মোচিত করেছে। কারণ তাদের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভারতের উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে খড়কূটোর মতো ভেঙে পড়েছে। তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান ভারতের সীমান্তে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত থাকলেও, ভারত পাকিস্তানের মূল অংশে একটি চূড়ান্ত আঘাত করেছে। ভারতীয় ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রগুলি অত্যন্ত নির্ভুলভাবে হামলা চালিয়েছে, পাকিস্তানের বিমানঘাঁটিগুলিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যা নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করে আসছিল। অথচ ভারতের প্রত্যাঘাতের প্রথম তিন দিনের মধ্যে পাকিস্তান তার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তান ঘর বাঁচাতে উপায় খুঁজতে শুরু করে, ক্রমবর্ধমান চাপ থেকে মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে আবেদন করে। তিনি বলেন, বিপুল ক্ষতির পর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ১০ মে বিকেলে ভারতের ডিজিএমও-এর সাথে যোগাযোগ করে। ততক্ষণে, ভারত পাকিস্তানে জঙ্গি শিবিরগুলি ধ্বংস করে ফেলেছে, গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিদের নির্মূল করেছে।
এ প্রসঙ্গে মোদি জানিয়ে দেন, পাকিস্তান তার আবেদনে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা ভারতের বিরুদ্ধে সমস্ত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করবে। এই প্রতিশ্রুতির পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী ও সামরিক ঘাঁটিগুলির বিরুদ্ধে ভারত পাল্টা অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও তিনি নিরাপত্তার বিষয়ে তিনটি মূল রূপরেখা তুলে ধরেছেন, এক, ভারতের উপর কোনো সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হলে নিজের শর্তে প্রতিশোধ নেবে। দুই, পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের জন্য কোনও সহনশীলতা দেখাবে না। তাঁর সাফ কথা, “ভারত পারমাণবিক হুমকিতে ভীত হবে না”। তিন, সন্ত্রাসের মদদদাতা এবং সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি জানিয়ে দেন, ‘অপারেশন সিন্দুরে’ বিশ্ব ফের পাকিস্তানের বিরক্তিকর অবস্থান প্রত্যক্ষ করেছে। পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে সন্ত্রাসবাদীদের শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন, যা রাষ্ট্র-মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের গভীর হৃদ্যতার প্রমাণ”।
প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, সব ধরণের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি হল তার ঐক্য। এই বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী পুনরায় বলেন, এই যুগ যুদ্ধের যুগ নয়, তাই এটি সন্ত্রাসবাদেরও যুগ হতে পারে না। তাঁর ঘোষণা, “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স একটি উন্নত এবং নিরাপদ বিশ্বের গ্যারান্টি”। তাই ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে দিতে মোদী ফের জানিয়ে দেন, “সন্ত্রাস এবং আলোচনা একসাথে চলতে পারে না, সন্ত্রাস এবং বাণিজ্য সমান্তরালভাবে চলতে পারে না এবং রক্ত এবং জল একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না”।