
স্পোর্টস ডেস্ক :এক ঝাঁক গোলের সুযোগ তৈরি করেও গোল পেল না ভারত। হারাতে পারল না বাংলাদেশকে। মঙ্গলবার এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের তৃতীয় ও চূড়ান্ত রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ম্যাচ শেষ হল গোলশূন্য অবস্থায়। ১৯৯৯-এর পর এই প্রথম দুই দলের মধ্যে ম্যাচের ফল হল ০-০। মাঝে যে কয়েকবার ফুটবল মাঠে মুখোমুখি হয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ, প্রত্যেকবারই গোল হয়েছে। কিন্তু ১৬ বছর পর গোলশূন্য ড্র করল তারা।
বাছাই পর্বের গ্রুপ ‘সি’-তে থাকা অপর দুই দল হংকং ও সিঙ্গাপুর-ও এদিন গোলশূন্য ড্র করে। ফলে গ্রুপের প্রতিটি দলই একই জায়গায় রয়ে গেল। ভারতের স্বস্তির কারণ বলতে শুধুমাত্র এটুকুই। মঙ্গলবারের ম্যাচে ভারতের পারফরম্যান্স দেখে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ খোদ কোচ মানোলো মার্কেজই। ম্যাচের পরে সম্প্রচার সংস্থার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “দলের এই পারফরম্যান্সে আমি শুধু হতাশ নই, ক্ষুব্ধও। এত খারাপ পারফরম্যান্স দেখে আমি অবাকও হয়েছি।” সারা ম্যাচে বাংলাদেশও কম সুযোগ পায়নি। এবং প্রতিপক্ষের মতো তারাও সেই সুযোগগুলি নষ্ট করেছে।
এ দিন শিলংয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে সারা ম্যাচে মাত্র দু’টি শট গোলে রাখতে পারে ভারত। তাদের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ অবশ্য তিনটি শট গোলে রাখে। গোল করার জন্য অবসর ভেঙে ফিরে আসা সুনীল ছেত্রী ম্যাচের শেষ দিকে যে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন, তা সত্যিই কোচকে হতাশ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। প্রথমার্ধে বাংলাদেশের অপ্রত্যাশিত আক্রমণাত্মক মেজাজে বেশ চাপে পড়ে যাওয়া ভারত প্রথমার্ধে সে ভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধে ভারত আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে পারলেও সঠিক ফিনিশিংয়ের অভাব প্রবল ভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। এই অর্ধে একটিও শট গোলে গোলে রাখতে পারেননি সুনীল, লিস্টনরা। এমনকী সেটপিস মুভগুলিকেও কাজে লাগাতে পারেনি তারা। ভারতের মাঝমাঠ ও আক্রমণ বিভাগের মধ্যে যেমন বোঝাপড়ার অভাব দেখা যায়, তেমনই অভিজ্ঞ ডিফেন্স লাইন-আপের মধ্যেও তেমন বোঝাপড়া ছিল না।
হয়তো একসঙ্গে বেশি না খেলার জন্যই তেমন বোঝাপড়া দেখা যায়নি। আগামী ১০ জুন যখন তারা পরের ম্যাচে সিঙ্গাপুরের মুখোমুখি হবে, তখন ভারতীয় ফুটবলারদের মধ্যে আরও ভাল বোঝাপড়া থাকবে, এমন আশা করা যায়। কারণ, তার আগে তাঁরা একসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে অনুশীলন করার ও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবেন।
এ দিন ভারতীয় রক্ষণে রাহুল ভেকে, শুভাশিস বোস ও সন্দেশ ঝিঙ্গনের মতো তিন অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার থাকলেও প্রথম কোয়ার্টারেই বাংলাদেশ একাধিক গোলের সুযোগ পায় এবং তিনটি কর্নার আদায় করে নেয়। প্রথম মিনিটেই ভুল করে মোজিবর জনির পায়ে বল তুলে দেন ভারতীয় গোলকিপার বিশাল কয়েথ এবং জনি প্রায় ফাঁকা গোল পেয়েও সাইড নেটে বল মারেন। এই সময় ভারতীয় ডিফেন্ডারদের চাপে রাখেন বাংলাদেশের আক্রমণ বিভাগের খেলোয়াড়রা।
ম্যাচের ১২ মিনিটের মাথায় মহম্মদ রিদয়ের গোলমুখী শট যখন গোললাইন সেভ করেন শুভাশিস বোস, তখন তাদের রক্ষণের বোঝাপড়ার অভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৮ মিনিটের মাথায় ফ্রি কিকের পর যে ভাবে বক্সের বাইরে থেকে উড়ে আসা বলে হেডে গোলের সুযোগ পেয়ে যান অরক্ষিত শাহরিয়ার ইমন, তাতে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
রক্ষণের এই চাপ কাটাতে পাল্টা আক্রমণে ওঠা শুরু করে ভারত। ২২ মিনিটের মাথায় বাংলাদেশের অধিনায়ক ও ডিফেন্ডার তপু বর্মন চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার ফলে তাদের আরও সুবিধা হয়ে যায়। পরের মিনিটেই তাঁর জায়গায় নামা রহমত মিয়া লিস্টন কোলাসোর গোলমুখী ফ্রি কিক ক্লিয়ার করতে গিয়ে প্রায় নিজ গোল করেই ফেলেছিলেন। কিন্তু অল্পের জন্য তা গোলের বাইরে চলে যায়।
এই সময়েই বাঁ প্রান্ত দিয়ে ঘন ঘন আক্রমণে উঠতে শুরু করেন লিস্টন কোলাসো এবং এই সুযোগে ভারতীয় ডিফেন্ডাররাও নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। ৩১ মিনিটের মাথায় গোলের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায় ভারত, যখন মাঝমাঠ থেকে বরিস সিংয়ের পাস পেয়ে বাঁ দিক দিয়ে উঠে বক্সের মধ্যে ক্রস পাঠান কোলাসো। উদান্ত সিং হেডে গোলের দিকে বল ঠেলেন। কিন্তু তা আটকে দেন গোলকিপার মিতুল মারমা। তাঁর হাত থেকে ছিটকে আসে বলে গোলে শট নেন ফারুখ চৌধুরি। কিন্তু সেই শটে তেমন জোর ছিল না। ফলে সহজেই তা ফের আটকে দেন মারমা। খেলার বয়স ৪০ মিনিট পেরনোর পরেই কর্নার থেকে সোজা জালে বল জড়াতে চেষ্টা করেন কোলাসো, যা ফের বিপদমুক্ত করেন মারমা।
ভারত আক্রমণে ফিরলেও বাংলাদেশ প্রায়ই বিপজ্জনক আক্রমণে উঠছিল। ৩৭ মিনিটের মাথায় এমনই এক আক্রমণে উঠে বরিসকে পরাস্ত করে বক্সের মধ্যে ক্রস পাঠান রাকিব হোসেন। তবে সেই উড়ন্ত বল বিশালের দখলে চলে যাওয়ায় বিপদ বাড়েনি। তবে ৪১ মিনিটের মাথায় রাকিব যে পাসটি বাড়ান জনির উদ্দেশে, তা বিশাল এগিয়ে এসে ডাইভ দিয়ে ক্লিয়ার না করলে গোল পেয়ে যেতে পারত বাংলাদেশ। প্রথমার্ধে দুই দলই পাঁচটি করে শট নেয়, যার মধ্যে দু’টি করে শট গোলে রাখে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দিকে আনতে পারেনি ভারত। শুরু থেকেই তাদের চাপে রাখে বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যেই আক্রমণের জায়গা তৈরি করে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করে তারা। ৫৫ মিনিটের মাথায় কোলাসো বাঁ দিক দিয়ে উঠে দূরের পোস্টের সামনে ক্রস পাঠান সুনীল ছেত্রীর উদ্দেশে। কিন্তু অনেকটা লাফিয়ে সেই বলের নাগাল পাননি সুনীল।
এর মিনিট তিনেক পরে কোলাসোর কর্নার থেকে ফের অনেকটা লাফিয়ে গোলে বল ঠেলার চেষ্টা করেন সুনীল। কিন্তু তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান হামজা চৌধুরি। এই সময়ে পরপর একাধিক কর্নার পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি ভারত। ৬৩ মিনিটের মাথায় ফের কোলাসোর কর্নারে শট নিয়ে বারের অনেক ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন সুনীল। বরিসের ক্রস ক্লিয়ার হওয়ার পর ৬৮ মিনিটের মাথায় বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নেন শুভাশিস, যা অল্পের জন্য বারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ম্যাচ ৬৫ মিনিট হয়ে যাওয়ার পর আয়ুষ ছেত্রী ও উদান্ত সিংয়ের জায়গায় নাওরেম মহেশ সিং ও সুরেশ ওয়াংজামকে নামায় ভারত। তাতে তাদের আক্রমণে কিছুটা গতি আসে। প্রতিপক্ষের ওপর চাপও ক্রমশ বাড়ায় তারা এবং বলের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টাও করে। ৭২ মিনিটের মাথায় ডান দিক থেকে সুনীলের ক্রসে গোলের সুযোগ পান ফারুখ। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট শট নেন তিনি। পরবর্তী মিনিটেই কোলাসোর কর্নারে উড়ে আসা বলে সামনে থেকে হেড করেও গোলে বল রাখতে পারেননি শুভাশিস।
ম্যাচের ৭৬ মিনিটের মাথায় মাঠে নামেন আইএসএলে ভাল ফর্মে থাকা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ব্রাইসন ফার্নান্ডেজ। তবে সম্প্রতি চোট পাওয়ায় তাঁকে শুরু থেকে নামাতে পারেননি ভারতীয় কোচ। ম্যাচের বেশিরভাগ সময়েই এ দিন বাঁ দিক দিয়ে আক্রমণে ওঠে ভারত। ডানদিকটা বেশ কমজোর ছিল তাদের। মহেশকে নামিয়েও এই সমস্যা মেটেনি। ব্রাইসনকে সম্ভবত সেই দায়িত্বই দেওয়া হয়।
তবে তাঁরা নামার পরেও বাঁ দিক দিয়েই বেশিরভাগ আক্রমণ হয় ভারতের। ৮৪ মিনিটের মাথায় মহেশের ক্রস থেকে গোলের সুযোগ পেয়ে যান বক্সের মধ্যে অরক্ষিত থাকা সুনীল ছেত্রী। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সঠিক সময়ে হেড করতে না পারায় সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন তিনি। এর পরেই তাঁর জায়গায় ইরফান ইয়াডওয়াডকে নামান মানোলো মার্কেজ। একই সঙ্গে শুভাশিসের জায়গায় নামেন আশিক কুরুনিয়ান। ম্যাচের শেষ কয়েক মিনিটে জয়সূচক গোলের উদ্দেশেই এই সিদ্ধান্ত নেন কোচ।
কিন্তু ৮৯ মিনিটের মাথায় ভারতই গোল খেয়ে যেত, যদি বাংলাদেশের পরিবর্ত ফরোয়ার্ড ফাহিমের আকস্মিক গোলমুখী জোরালো শট বাঁদিকে ডাইভ দিয়ে না বাঁচাতেন বিশাল। এই সময়ে ভারতীয় রক্ষণের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ। পাঁচ মিনিটের সংযুক্ত সময়ে গোলের সুযোগ পেয়েও সেগুল কাজে লাগাতে পারেনি কোনও দলই।