
তাপস মহাপাত্র : রাজ্যে শিল্পোন্নয়ন নিয়ে বিরোধীদের চলতি খোঁচার যোগ্য জবাব দিতে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চকেই বেছে নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, কর্মসংস্থান ছাড়া পরবর্তী প্রজন্ম টিকতে পারবে না। প্রসঙ্গত, ২১-এ ফের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়ে মমতা ‘বাংলার শিল্পায়ন’কেই প্রধান লক্ষ্য করার কথা বলেছিলেন। তা যে শুধু কথার কথা নয়, সম্ভবত তা বোঝাতে এবার বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চকে ব্যবহার করতে চাইলেন। তাঁর সাফ কথা, বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে তাকিয়েই তার শিল্পনীতি। তাই জোর দিতে চাইছেন- শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। বলাইবাহুল্য, একজন দুঁদে রাজনীতিবিদ হিসেবে উন্নয়নের প্রক্রিয়া থেকে কী ভাবে জনমোহিনী শ্লোগান তুলে আনতে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তা বিলক্ষণ জানা। বস্তুত, রাজ্যের উন্নয়ন আর দলের উন্নতির মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে যে তিনি এগোতে চাইছেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই গত কয়েক বছর ধরে তিনি বলে আসছেন, রাজ্যে শিল্পস্থাপনে আলগা হয়েছে সরকারি লালফিতের ফাঁস। এবং তা নিয়ে এবারও তিনি শিল্পিপতিদের আশ্বস্ত করার প্রক্রিয়া জারি রেখেছেন। তুলে ধরছেন বাংলার অধুনা কর্মসংস্কৃতিকে।
এবারেও বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন ঘিরে বসেছে চাঁদের হাট। প্রতিবারের মতো এবারও আলোচিত হচ্ছে নানান প্রকল্প নিয়ে, বিনিয়োগ নিয়ে। সভা আলো করে রয়েছে রিলায়েন্স, আরপিএসজি, অম্বুজা গ্রুপ, জেএসডব্লিউ, আইটিসি। ২০১৬ সালে প্রথম বিজিবিএসের সময়ে এ রাজ্যে রিলায়েন্সের বিনিয়োগ ছিল ২০০০ কোটি টাকার কম, এবার সেটা বেড়ে আগামী দিনে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হতে চলেছে। আরপিএসজি-র সঞ্জীব গোয়েঙ্কা জানিয়েছেন, তাঁর সংস্থা বিনিয়োগ বাড়াবে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা। অম্বুজাও আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর কথা বলেছে। ২০০০ একর জমির উপর শিল্প তালুক গড়ার কথা বলেছে জিন্দাল গোষ্ঠী। এ রাজ্যে বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন আইটিসির সঞ্জীব পুরীও।
ক্ষমতায় আসার আগে তিনি যে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেই ভূমিকা যে সময়ের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য নয় এটা তাঁর অজানা নয়। তাই বদলেছে সিঁঙ্গুরের অভিমুখ। যে কোনো ক্ষমতাসীন দলের কাছে রাজনীতি আর প্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্যের প্রয়োজনটা এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না অগ্নিকন্যার।
কিন্তু কথা হল, রাজ্যের উন্নয়নের ব্যাপারে কতটা জোর দেওয়া হচ্ছে তার ভৌগলিক সুযোগ সুবিধা ও প্রাকৃতিক সম্ভারে। ভারতের বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী রাজ্য হল পশ্চিমবঙ্গ। আলু ও মাছ উৎপাদনকারীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম। পার্শ্ববর্তী রাজ্য হিসেবে রয়েছে- ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, সিকিম এবং আসাম। সীমান্তে রয়েছে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাজ্য হল পশ্চিমবঙ্গ। ২০২৪-২৫ সালে মোট রাজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ১৮.৮ ট্রিলিয়ন টাকা (২২৭.০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৫ আর্থিক বছরে (আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত) রাজ্য থেকে মোট রপ্তানি ছিল ৪,৭৫৫.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া, এই রাজ্য প্রকৌশল সামগ্রী এবং রত্ন ও অলঙ্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রপ্তানি করে চলেছে। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও নজির গড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী রাজ্য এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত দার্জিলিং চা জাতের আবাসস্থল। শুধু তাই নয়, এই রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারগুলির জন্য একটি কৌশলগত করিডোরও। কিন্তু এর অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যটিকে পূর্ব ভারত, উত্তর-পূর্ব, নেপাল এবং ভুটানের জন্য একটি ঐতিহ্যবাহী বাজারে পরিণত করার কাজে কী উদ্যোগী হতে দেখা গেছে !
এবারও বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশিষ্ট শিল্পপতি ও বেনিয়াদের সামনে রাজ্যের সুযোগ সুবিধা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা বললেন। পশ্চিমবঙ্গকে তিনি বিশ্ববাণিজ্যের সুবর্ণ করিডোর হিসেবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু ফলাফল কি ? সবই কি সেই রাজনীতির অক্টোপাশে জড়িয়ে থাকছে না ? মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আশাবাদী। কিন্তু আর কতদিন বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখে পেট ভরাবে কার্যত এই বিপুল কর্মহীন বঙ্গ, সাধারণ মানুষের প্রশ্ন এটাই।