
ওঙ্কার ডেস্ক : মা, শুধু এই শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সভ্যতার আতুড়ঘর। যেখান থেকে শুরু হয় মহাকালের যাত্রা। প্রতিটি শিশুই ভূমিষ্ঠ হয় সময়কে বয়ে চলার জন্য। যার প্রারম্ভের নাম- মা। আমরা কেউই ছুঁতে পারি না সেই বৃহত মায়ের কোল। আমরা যে যার মায়ের কোল থেকে পথে নামি সময় বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই গোটা বিশ্বে মাতৃদিবস একটি বিশেষ দিন।
রিয়াকে সম্মান জানাতে এই দিবস উদযাপনের সূত্রপাত। যিনি প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা অনুসারে দেবতাদের মা ছিলেন। তারপর, যুক্তরাজ্যে শুরু হয় মাদারিং সানডে। লোকেরা গির্জায় গিয়ে এই দিনটি উদযাপন করতেন।
মা দিবসের অধুনা উৎপত্তি জুলিয়া ওয়ার্ড হাও এবং আনা জার্ভিসের কাছ থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৮৭০ সালে, জুলিয়া ওয়ার্ড হাও প্রতি বছর মা দিবস উদযাপনের আহ্বান জানান। এই নিয়ে বিতর্ক অবশ্য আছে। কেউ কেউ বলেন করেন জুলিয়েট ক্যালহাউন ব্লেকলি ১৮০০ সালের দিকে মিশিগানের অ্যালবিয়নে মা দিবসের সূচনা করেছিলেন। তার ছেলেরা তখন প্রতি বছর তাকে শ্রদ্ধা জানাতেন। ১৯০৭ সালে আনা জার্ভিস ব্যক্তিগতভাবে মা দিবস উদযাপন করেছিলেন। এটি ছিল তার মায়ের জন্মদিন। ১৯০৮ সালে, তিনি একটি গির্জার প্রার্থনার আয়োজন করেছিলেন যেখানে ৪০৭ জন শিশু এবং মা উপস্থিত ছিলেন। এরপর, ১৯১২ সালে, আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি গঠিত হয়। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল অন্যান্য দেশে মা দিবসের প্রচার করা।
এমন একটি ঐতিহাসিক দিনে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দৃষ্টান্তমূলক ভাবে ভারতে মা ও শিশুর বিপদ এখন অনেক কম। মা দিবসে এমন একটি সুখবর যে কোনো জাতীর কাছে সামাজিক উন্নতির স্পষ্ট বার্তা বহন করে।
২০২১ সালের ‘নমুনা নিবন্ধন ব্যবস্থা’ (এসআরএস) রিপোর্টে উঠে এসেছে সেই আশার আলো। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অধীনস্থ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের ‘সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ (SDG) অর্জনের পথে দ্রুত এগোচ্ছে ভারত। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হারে রেকর্ড অনেক কমেছে। ২০১৪-১৬ সালের তুলনায় মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ২৮.৫% — প্রতি লক্ষ জীবিত জন্মে যেখানে মৃত্যু ছিল ১৩০, তা কমে ২০১৯-২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৯৩। শিশুমৃত্যুর হারও নেমে এসেছে — ২০১৪ সালের ৩৯ থেকে ২০২১ সালে তা কমে হয়েছে ২৭। নবজাতক মৃত্যুহার দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে ১৯, যা ২০১৪ সালে ছিল ২৬। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হার কমে এসেছে প্রতি হাজারে ৩১। এই উন্নতির মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জন্মের সময় লিঙ্গ অনুপাতের উন্নতি। ২০১৪ সালের ৮৯৯ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে তা হয়েছে ৯১৩। মোট উর্বরতা হার ২০১৪ সালের ২.৩ থেকে কমে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২.০।
এসআরএস রিপোর্ট অনুযায়ী, আটটি রাজ্য ইতিমধ্যেই মাতৃমৃত্যু সংক্রান্ত SDG লক্ষ্যমাত্রা ছুঁয়ে ফেলেছে। সেগুলি হল কেরল (২০), মহারাষ্ট্র (৩৮), তেলেঙ্গানা (৪৫), অন্ধ্রপ্রদেশ (৪৬), তামিলনাড়ু (৪৯), ঝাড়খণ্ড (৫১), গুজরাট (৫৩) ও কর্ণাটক (৬৩)।
পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সাফল্য পেয়েছে ১২টি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। কেরল (৮) ও দিল্লি (১৪)-র মতো রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ (২০), জম্মু ও কাশ্মীর (১৬), তেলেঙ্গানা (২২), হিমাচল প্রদেশ (২৩)-এর মতো রাজ্যগুলিও তালিকায় নাম তুলেছে। নবজাতক মৃত্যুহার রুখতে ছয়টি রাজ্য ইতিমধ্যেই লক্ষ্যে পৌঁছেছে — কেরল, দিল্লি, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, জম্মু ও কাশ্মীর, এবং হিমাচল প্রদেশ।
৭ এপ্রিল, ২০২৫ জাতিসংঘের ‘মাতৃমৃত্যু মূল্যায়ন’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে আরও ২৩ পয়েন্ট। বিগত ৩৩ বছরে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যেখানে বিশ্বজুড়ে কমেছে ৪৮%, সেখানে ভারতে এই হ্রাস ৮৬%—এক কথায় ব্যতিক্রমী। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বক্তব্য, এর পিছনে রয়েছে সরকারের একাধিক কৌশলগত হস্তক্ষেপ ও প্রকল্প। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক পরিবার বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য কভারেজ পাচ্ছে। প্রসবকালীন বিনামূল্যে পরিষেবা, সিজারিয়ানসহ হাসপাতালে ভর্তি, পরিবহণ, ওষুধ ও পুষ্টি সহায়তা এখন গর্ভবতী মায়েদের অধিকারে পরিণত হয়েছে।
মাতৃত্বকালীন অপেক্ষা কেন্দ্র, শিশু-জন্মকালীন ইউনিট, এনবিএসইউ, এসএনসিইউ-র মতো সুবিধা যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। নবজাতকের ক্ষেত্রে সিপিএপি ব্যবস্থার মতো আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রোটোকল ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে বছরে এখন ৩০ কোটি নিরাপদ গর্ভাবস্থা ও ২৬ কোটি জীবিত জন্ম নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।
স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো আরও মজবুত করতে প্রশিক্ষিত ধাত্রী, কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার মোতায়েন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য তথ্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংগ্রহ হওয়ায় বাস্তবভিত্তিক নীতি নির্ধারণ এখন আরও সহজ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের আগেই ভারতের পক্ষে SDG লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে।