
সায়ন মাইতি,পশ্চিম মেদিনীপুর: মোগলমারি হল পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম সীমান্ত দাঁতন এক নম্বর ব্লকের একটি ঐতিহাসিক গ্রাম ।সপ্তদশ শতাব্দীতে মির্জা নাথান লিখিত “বাহারিস্তান-ই- ঘাইবি” বইটি থেকে জানা যায় ১৫৭৫ সালে মেদিনীপুর আর জলেশ্বরের (ওড়িশা ) মাঝামাঝি ‘তুকারুই’ নামে এক স্থানে মোঘল ও পাঠানের যুদ্ধ হয় ।সেই যুদ্ধে মোঘলদের বহু ক্ষয় ক্ষতি হয় ।সেই মোঘল থেকেই হয়তো মোগলমারি নামের উৎপত্তি হয় বলে মনে করা হয় ।। এই দাঁতনের পুরনো নাম “দন্তভুক্তি” ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন ।সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে এই দন্ত ভুক্তিতেই তাঁর ভূমিদানের দলিল পাওয়া যায় ।
মোঘলমারিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র করার চিন্তা ভাবনা করছে রাজ্য সরকার। দাঁতনের এই স্থানে খননকার্য চালিয়ে বৌদ্ধমহাবিহারের সন্ধান পেয়েছে রাজ্য প্রত্নতত্ব বিভাগ। এই বিভাগের আধিকারিকদের মতে এই মহাবিহার নালন্দার সমসাময়িক এবং নালন্দার মহাবিহারের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন মোঘলমারিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে তুলে ধরা হলে এই এলাকার অর্থনীতি উন্নত হবে।
খড়গপুর থেকে যে রাস্তা বালেশ্বর গিয়েছে, সেই ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের কাছে, ওড়িশা রাজ্য সীমান্তে অবস্থিত মোঘলমারিতে প্রায় এক দশক আগে খননকাজ শুরু হয়। তখন সেই কাজ হচ্ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্বাবধানে। পরে রাজ্য প্রত্নতত্ব বিভাগ এই জায়গাটি অধিগ্রহণ করে। বিভিন্ন সময়ে খনন কাজ চালিয়ে প্রত্নতাত্বিকরা দেখেছেন নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে এই জায়গার অনেক মিল আছে এবং মোঘলমারির এই বৌদ্ধ মহাবিহারটি খুব সম্ভবত ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি করা হয়েছিল। কার কারোর মতে এটি পঞ্চম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল।
চিনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন তার লেখায় দক্ষিণবঙ্গের যে সমস্ত মহাবিহারের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে মোঘলমারির এই মহাবিহারের উল্লেখও রয়েছে।
খনন কাজ চালিয়ে এখানে দেওয়ালে নানা রকম মুর্তি, মানুষের আদলে মুর্তি, ‘ ফ্লোরাল’ মোটিফ, ‘ভোটিভ ট্যাবলেট’, স্ট্যাকো মুর্তি, নানা রকম মুদ্রা, পাত্র, বুদ্ধদেবের নানা আকারের মুর্তি ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে। খনন কাজ চালিয়ে এখনও পর্যন্ত যা পাওয়া গিয়েছে তাতে মনে করা হচ্ছে এই বৌদ্ধ মহাবিহারের আকার বেশ বড় ছিল। যে জিনিসগুলি এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে তার কিছু কিছু নিদর্শন এই মহাবিহারের এলাকার মধ্যেই একটি ‘মিউজিয়ামে’ রাখা আছে। আগামী দিনে এখানে একটি বড় আকারের মিউজিয়াম করার পরিকল্পনাও রয়েছে রাজ্য সরকারের।
রাজ্য সরকার এই উদ্যোগ নেওয়ায় খুশি এলাকার বাসিন্দারা। এরই সঙ্গে তারা বলেন এই স্থাপত্যকে রক্ষা করতে ওপরে একটি ‘শেড’ দেওয়া দরকার কারণ বৃষ্টি এবং অন্যান্য কারণে এখানের মুর্তি ও দেওয়ালগুলি নষ্ট হচ্ছে। যদিও রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় দাঁতন 1 নম্বর ব্লক বিডিওর উদ্যোগে এখানে একটি ‘শেড’ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসীদের দাবি এই ‘শেড’ টিও বর্তমান জরাজীর্ণ অবস্থা। বৃষ্টি হলে জল গিয়ে পড়ছে মূর্তি ও দেওয়াল গুলিতে। এছাড়াও মোগলমারীর ভেতরে আংশিক খননকৃত অংশের চারিদিকে কাঠের পাঠাতন সহ সিঁড়ি ও কাচের ব্যারিকেট দেওয়া হয়েছে। বসানো হয়েছে উচ্চ বাতি স্তম্ভ।
বাসিন্দারা বলেন, মোঘলমারির মতই দাঁতনের একটি অন্যতম দেখার জিনিস এখানের শরশঙ্কা দিঘি। এছাড়াও এই এলাকায় আরও অনেক প্রাচীন মন্দির ও দেখার জিনিস আছে। মোঘলমারি ঘুরতে এসে এই সবও দেখে নিতে পারবেন পর্যটকরা, যার ফলে আগামী দিনে পর্যটনকে কেন্দ্র করে আগামি দিনে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতির আশাও করছেন তারা।