
স্পোর্টস ডেস্ক :চলতি শতকের শুরুর দিকে বাংলার ফুটবলে ঝড় তুলেছিলেন এক স্ট্রাইকার, অনেকে যাঁকে এখনও বলেন, শিশির ঘোষের পর শেষ বাঙালি ফরোয়ার্ড, যিনি জনপ্রিয়তার চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। কলকাতার দুই প্রধান ক্লাবের জার্সি গায়েই রীতিমতো দাপটের সঙ্গে খেলেছিলেন তিনি।
তারকা ফরোয়ার্ড দীপেন্দু বিশ্বাস যখন খ্যাতির শিখরে, যখন ভারতীয় ফুটবলে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি, তখন কি আর কেউ ভাবতে পেরেছিল যে, দু’দশক পরে আর এক দীপেন্দু বিশ্বাস উঠে আসবেন বাংলার ফুটবল আলো করে? নিশ্চয়ই না। কিন্তু সেই সময়েই গোকুলে বাড়া শুরু হয় ডিফেন্ডার দীপেন্দুর।
চম্পাহাটির নাম অনেকেই শুনেছেন সেখানকার আতসবাজি শিল্পের জন্য। এ বার সেই চম্পাহাটিকে এ বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা চিনবেন এই নয়া দীপেন্দু বিশ্বাসের জন্যও। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ওই আধা গ্রাম-আধা শহর থেকেই যে উঠে এসেছেন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের তরুণ ডিফেন্ডার দীপেন্দু বিশ্বাস।
চম্পাহাটির দীপেন্দু ছোটবেলা থেকেই সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে মাঠে নামার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয় গত মরশুমেই। কিন্তু এ মরশুমে সেই স্বপ্ন যেন রূপকথায় পরিণত হয়েছে। এ বার এক নয়, জোড়া খেতাব জিতেছে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট এবং দলের এই সাফল্যে তাঁরও অবদান অবশ্যই রয়েছে। স্প্যানিশ কোচ হোসে মোলিনা বরাবরই ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন তাঁর। দীপেন্দুও কোচের আস্থার যথাযথ দাম দিয়েছেন।গত বছর আইএসএলে অভিষেক হওয়ার পর অল্প সুযোগ পেলেও ভাল খেলে নজর কেড়েছিলেন দীপেন্দু। ২০২৪-২৫ মরশুমে নিজের দক্ষতায় আরও শান দিয়ে দেশের ফুটবল মহলের নজর কেড়ে নেন গত বৃহস্পতিবারই ২২ পূর্ণ করা এই তরুণ। যখনই মাঠে নেমেছেন, ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, দলকে পাঁচটি ম্যাচে গোল অক্ষত রাখতে সহায়তা করেন। শুধু তা-ই নয়, একটি গোল করেন ও দুটি অ্যাসিস্টও করেন তিনি। সেই দীপেন্দু এ বার সবুজ-মেরুন বাহিনীর কলিঙ্গ সুপার কাপ অভিযানে বড় ভরসা। শুভাশিস বোস, আলবার্তো রড্রিগেজ, টম অলড্রেড, আশিস রাই-দের অনুপস্থিতিতে জুনিয়রদের সঙ্গে তাঁকেই নিতে হবে দলের দূর্গরক্ষার দায়িত্ব।
একটি দলের সাফল্যের ধারাবাহিকতা নির্ভর করে রিজার্ভ বেঞ্চের শক্তির ওপর এবং ২০২৪-২৫ মরশুমে এই রিজার্ভ বেঞ্চই ইন্ডিয়ান সুপার লিগে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে অন্য দলগুলির চেয়ে আলাদা করে দেয়। মেরিনার্সরা ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় দল হিসেবে আইএসএলের জোড়া খেতাব অর্জন করে। লিগ শিল্ড ও কাপ—দুটোই জিতে নেয় তারা। এই সাফল্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন ডিফেন্ডার দীপেন্দু। রক্ষণভাগের নিয়মিত খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতিতে অসাধারণ ভাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের সিনিয়র দলে জায়গা পাওয়ার পর থেকে টানা দু’মরশুমে ক্লাবের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম অধ্যায়ে নিজের নাম খোদাই করেন তিনি।
সম্প্রতি indiansuperleague.com কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বহুমুখী ডিফেন্ডার সবুজ-মেরুন বাহিনীর সাফল্যময় মরশুম এবং নিজের ফুটবল যাত্রা নিয়ে বলেন, “এ এক অসাধারণ অনুভূতি। এটা সবার স্বপ্ন। গত বছর আমরা প্লে-অফ ফাইনালে হেরে গিয়ে রানার্স আপ হয়েছিলাম। এ বার আমরা চ্যাম্পিয়ন। আমি খুব খুশি। আমার মা-বাবাও মাঠে ছিলেন, তাই আরও ভাল লেগেছে”।
চাপের মুখেও ঠাণ্ডা মাথা বজায় রাখা ও বিচক্ষণতার জন্য পরিচিত দীপেন্দু ছোটবেলায় অনেক বাধা পেরিয়ে এই সাফল্যের মোড়ে পৌঁছেছেন। তবে কঠিন সময়ে মাঠের মতো মাঠের বাইরেও বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কোভিডের ভয়ঙ্কর সময়ে যে তাঁর ফুটবল জীবন প্রায় শেষের পথে চলে গিয়েছিল, তা নিজেই জানিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে দীপেন্দু বলেন, “কোভিডের সময় মনে হয়েছিল, আর কিছু হবে না। হয়তো ফুটবল ছেড়েই দিতে হবে। যদিও পুরোপুরি ছাড়ার কথা ভাবিনি, কিন্তু সেই খেলতে চাওয়ার ইচ্ছেটা তখনও ছিল। আমি ভবিষ্যতে জীবনে কিছু করতে চেয়েছিলাম। সেটাই ছিল মোটিভেশন। তাই খেলা ছাড়িনি”।
সবুজ-মেরুন বাহিনীর এই উদীয়মান তারকা জানান, তাঁর মা-বাবা সব সময় তাঁর পাশে থেকেছেন এবং ফুটবলের প্রতি তাঁর ভালবাসাকে জিইয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সেই স্মৃতি ফিরিয়ে তিনি বলেন, “আমি যখন ফুটবল শুরু করি, তখন থেকে আমার মা-বাবা সব সময় আমাকে সমর্থন করেছেন। তাঁরা কখনও খেলার জন্য আমাকে বকাবকি করেননি বা খেলতে বাধাও দেননি। বরং প্রতি ম্যাচে ভাল খেলার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। তাই আজ ওঁরাও খুব খুশি”।
তবে তিনি যে একজন একনিষ্ঠ মোহনবাগান সমর্থক, তাও জানাতে ভোলেননি দীপেন্দু। তাই প্রতি বার মাঠে নামার সময় সবুজ-মেরুন রঙ রক্তে মিশিয়ে নিয়ে খেলেন। এই কারণেই নিজের স্বপ্নের ক্লাবকে বেনজির সাফল্য এনে দিতে পেরে আরও বেশি খুশি তিনি।
“আমি আগে একজন মোহনবাগান সমর্থক, তার পর এই ক্লাবের ফুটবলার”, বলেন গর্বিত রক্ষণপ্রহরী। মাঠে নামার সময়ও এটাই মাথায় রাখেন দীপেন্দু। তাই বোধহয় নিজেকে অন্যদের চেয়ে আরও বেশিই উজ্জীবিত করে তুলতে পারেন। তাঁর এই মানসিকতাই তাঁকে মোহনবাগানের ঘরের ছেলে করে তুলতে পারে কি না, এখন সেটাই দেখার।