
স্পোর্টস ডেস্ক :কলিঙ্গ সুপার কাপের প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিল গতবারের চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গল এফসি। রবিবার ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে কেরালা ব্লাস্টার্সের কাছে ০-২-এ হেরে ছিটকে যায় তারা। তাদের হারের ফলে আর শনিবার কোয়ার্টার ফাইনালে কলকাতা ডার্বি দেখা হবে না ভুবনেশ্বরের ফুটবলপ্রেমীদের। কেরালা ব্লাস্টার্সকে খেলতে হবে ইতিমধ্যেই কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যাওয়া আইএসএলে জোড়া খেতাবজয়ী মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের বিরুদ্ধে।
এ দিন পূর্ণশক্তির দল নিয়ে নামা কেরালার আইএসএল দল রীতিমতো দাপুটে ফুটবল খেলে জয় ছিনিয়ে নেয়। শুরু থেকেই আধিপত্য বিস্তার করা দলকে প্রথমার্ধে পেনাল্টি থেকে পাওয়া গোলে এগিয়ে দেন তাদের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড জেসুস জিমিনিজ। এই গোলের আগে যে সব সুযোগ হাতছাড়া করেন, সেগুলি কাজে লাগাতে পারলে আরও তিন গোল পেতে পারতেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবধান বাড়ান মার্কিন স্ট্রাইকার নোয়া সাদাউই। সারা ম্যাচে ১২টি শট নিলে একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি কলকাতার দল। ব্লাস্টার্সের ১৪টি শটের মধ্যে তিনটি ছিল লক্ষ্যে।
ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্সে এ দিন পরিকল্পনার অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। তিন সপ্তাহের প্রস্তুতির ছাপ দেখা যায়নি তাদের খেলায়। বিশেষ করে তাদের দুই বিদেশী ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকস ও রাফায়েল মেসি বৌলিকে কার্যত খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই দু’জনের কাছে বল পৌঁছতে না দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল নতুন কোচ ডেভিড কাতালার অধীনে প্রথম খেলতে নামা কেরালার দলটি।
লাল-হলুদ বাহিনীর অন্যতম ভরসা পিভি বিষ্ণুকেও কড়া পাহাড়ায় রাখে প্রতিপক্ষরা। মহেশ, জিকসন ও দ্বিতীয়ার্ধে নামা সউল ক্রেসপোও এ দিন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেননি। যেটুকু চেষ্টা করেছেন, তা করেন রিচার্ড সেলিস। ফলে ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠ ও আক্রমণে তীব্রতা ও গতি খুঁজে পাওয়া যায়নি একেবারেই। উল্টে ম্যাচের বেশিরভাগ সময়ই নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রেখে আধিপত্য বিস্তার করেন আদ্রিয়ান লুনা-রা।
দুই দলই এ দিন আক্রমণাত্মক মেজাজে খেলা শুরু করে। তবে কেরালার দলের দাপটই ছিল বেশি। ম্যাচের শুরুতেই সিটার মিস করেন জেসুস জিমিনিজ। ডান দিক দিয়ে ওঠা নোয়া সাদাউইয়ের ক্রসে গোললাইনের সামনে সুযোগ পেয়েও ঠিকমতো ট্যাপ করতে পারেননি তিনি। অবিশ্বাস্য ভাবে বল বাইরে পাঠান জিমিনিজ। ১৯ মিনিটের মাথাতেও এমনই একটি ক্রস বাড়িয়েছিলেন নোয়া, কিন্তু দানিশ ফারুখের কাছে বল পৌঁছনোর আগেই তা বিপদসীমার বাইরে বের করে দেন লাল-হলুদ গোলকিপার প্রভসুখন সিং গিল।
এর দু’মিনিট পর ফের পিছন থেকে বক্সের মধ্যে জিমিনিজের উদ্দেশে বল পাঠান নোয়া, যাতে ঠিকমতো পা লাগাতে পারলে হয়তো গোল পেতেন। কিন্তু পারেননি জিমিনিজ। ৩৪ মিনিটের মাথায় ফের কাট ব্যাক করে তাঁকে প্রায় গোল সাজিয়ে দেন নোয়া। কিন্তু এ বারেও ব্যর্থ হন তিনি। ৩৯ মিনিটের মাথায় পেনাল্টিও মিস করেন জিমিনিজ। কিন্তু শট নেওয়ার আগেই প্রভসুখন লাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসে বল আটকে দেওয়ায় ফের স্পট কিক নেওয়ার সুযোগ পান তিনি এবং দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় গোল পান তিনি (১-০)। আনোয়ার আলি বক্সের মধ্যে নোয়াকে ফাউল করায় এই পেনাল্টি পায় ব্লাস্টার্স।
অন্য দিকে, ম্যাচ শুরুর মিনিট ছ-সাত পর থেকে প্রতি আক্রমণে উঠতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। আট মিনিটের মাথায় সেলিসের কোণাকুনি শট দূরের পোস্টের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাফায়েল মেসি বৌলি ও দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসকে সামনে রেখে দল সাজান তাদের কোচ অস্কার ব্রুজোন। বাঁ প্রান্ত দিয়ে পিভি বিষ্ণু ও ডান প্রান্ত দিয়ে মহম্মদ রকিপকে আক্রমণ তৈরির দায়িত্ব দেন তিনি। বিষ্ণু শুরু থেকে সেই চেষ্টা করলেও রকিপ সে ভাবে আক্রমণে উঠতে পারেননি।
এই সময়ে বেশ কয়েকটি কর্নার আদায় করে নিলেও ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণে তেমন পরিকল্পনা, তীব্রতা বা ধার ছিল না। ফলে তাদের সামলাতে অসুবিধা হয়নি ব্লাস্টার্স ডিফেন্ডারদের। মেসি বা দিয়ামান্তাকস—কাউকেই সে ভাবে জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি প্রথমার্ধে। ৩৬ মিনিটের মাথায় শর্ট কর্নারের পরে মহেশের কাছ থেকে বল পেয়ে বাঁ উইং থেকে সোজা গোলে শট নেন সেলিস, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
গোল খাওয়ার পরেই বাঁ উইং দিয়ে প্রতিপক্ষের তিন খেলোয়াড়কে ধোঁকা দিয়ে বক্সে ঢুকে সোজা গোলে শট নেন বিষ্ণু। কিন্তু তা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে ফের শট নেন মেসি বৌলি, যা প্রায় ফাঁকা গোলের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রথমার্ধে একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি তারা।
দ্বিতীয়ার্ধে জিকসনের জায়গায় মাঠে নামেন সউল ক্রেসপো ও রকিপের জায়গায় নামেন নিশু কুমার। তবে ব্লাস্টার্সের দাপট একটুও কমেনি। শুরু থেকেই ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা করে তারা। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম কোয়ার্টারে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছেই ছিল। ৫৬ মিনিটের মাথায় ফের ইস্টবেঙ্গলের জালে বল জড়িয়ে দেন জিমিনিজ। কিন্তু তিনি অফসাইডে থাকায় সেই গোল বাতিল হয়ে যায়।
এই সময় চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান ব্লাস্টার্সের আক্রমণের অন্যতম নির্ভরযোগ্য তারকা ও অধিনায়ক আদ্রিয়ান লুনা। কিন্তু তাতে তাদের দাপট একটুও কমেনি। বরং ৬৪ মিনিটের মাথায় ফের গোল করে ব্যবধান বাড়িয়ে নেয় তারা। এ বার গোল করেন নোয়া সাদাউই, যিনি ডান প্রান্ত থেকে ইস্টবেঙ্গলের দুই ফুটবলারকে পরাস্ত করে কাট ইন করেন এবং বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ে দূরপাল্লার জোরালো শট নেন, যা বারের নীচে লেগে গোলে ঢুকে যায় (২-০)। গোলকিপার গিল লাফিয়ে উঠে হাত দিয়ে বল আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
দ্বিতীয় গোল খাওয়ার পর নন্দকুমার শেকরকে নামায় ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু যেখানে প্রথম এগারোর ফরোয়ার্ডদেরই দ্বিতীয়ার্ধে কার্যত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেখানে নন্দকুমার নেমে কতটাই বা সাহায্য করতে পারতেন দলকে, সেটাই ছিল প্রশ্ন। বরং কোয়ামে পেপরাকে নামিয়ে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করে ব্লাস্টার্স। ৭৫ মিনিটের মাথায় অফ সাইডের ফাঁদে না পড়লে দলকে তৃতীয় গোলও এনে দিতে পারতেন তিনি।
সারা ম্যাচে একটিও ইতিবাচক সুযোগ করতে না পারা মেসি বৌলিকে তুলে নিয়ে ৮৩ মিনিটের মাথায় ডেভিড লালনসাঙ্গাকে নামান লাল-হলুদ কোচ ব্রুজোন। কিন্তু ওই সময়ে দু’গোলে পিছিয়ে থাকার চাপ সামলে দলকে খেলায় ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন ছিল। বিশেষত, দু’গোলে এগিয়ে থাকা ব্লাস্টার্স যেখানে নিজেদের দূর্গের সামনে প্রায় পাঁচিল তুলে দেয়। সংযুক্ত সময়ে পরিবর্ত ডিফেন্ডার নিশু কুমারের ভুলে ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে বক্সের মাথায় থেকে বারের ওপর দিয়ে নোয়া বল উড়িয়ে না দিলে আরও বেশি ব্যবধানে জিততে পারত তারা।
ম্যাচের পর ইস্টবেঙ্গলের কোচ ব্রুজোন বলেন, “হতাশাজনক পারফরম্যান্স। দলের অনেক খেলোয়াড়ই নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেনি। আমাদের জেতার মানসিকতা ছিল না। এরকম মানসিকতা নিয়ে খেলতে নামলে কখনও এ রকম কঠিন দলের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতা যায় না”