
সমরবাগচী (১৯৩৩-২০২৩)
বিশ্বেন্দু নন্দ
বর্ষার দিনে প্রয়াত হলেন সমর বাগচীমশাই।সংবাদমাধ্যমের গুরু স্থানীয় সম্পাদকমশাই সমরবাবু সম্বন্ধে আমায় লিখতে আদেশ দিয়েছেন। সেই আদেশ শিরোধার্য করে, আমার আরেক গুরুস্থানীয় পিতৃবন্ধু মহাপ্রাণ সমরবাগচী সম্বন্ধে দুএক কথায় প্রণতি জানালাম।
বাম-প্রগতিশীল গোষ্ঠী যাকে বিজ্ঞান আন্দোলন বলে মনে করে, সেই প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জ্ঞানপিপাসাকে আন্দোলনের রূপে খুব সহজ পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ভদ্রবিত্তীয় সমাজে চারিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলেন সমরবাগচী। একই সঙ্গে মেধা পাটকরের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এনএপিম গোষ্ঠীর অধিকার, পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন গভীর ভাবে, এই পরিচয়টা আমি কোন ও স্মৃতি আলোচনায় দেখিনি বলেই বিশেষ করে উল্লেখ করলাম।
আমি তাঁকে প্রথম দেখি বড়িশা হাইস্কুলের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ১৯৮২তে অনেক দিন ধরে চলা উৎসবের প্রেক্ষিতে। আমার তখন দশম শ্রেণী, কয়েক মাস পরেই মাধ্যমিক।শিক্ষক বাবার উৎসাহে, তাঁর হাত ধরে বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামে প্রথম গেলাম সমরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য ছিল উৎসবের দিনগুলোয় জাদুঘরের বিজ্ঞানের নানান সূত্রগুলো হাতে কলমে করে দেখানোর প্রদর্শনী আনার ব্যবস্থা করা। বুঝলাম বাবা তাঁকে আগে থেকেই চিনতেন অধ্যাপক আন্দোলনের নেতা ফার্ন রোডস্থ সতীন চক্রবর্তীর পরিচয় সূত্রে। সেই সূত্রে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার পর বেশ কয়েকবার গিয়েছি তাঁর দপ্তরে। তারপরে বহুবার অনেককে নিয়ে জাদুঘর ঘুরতে গিয়েছি। মনে আছে জাদুঘর প্রেক্ষাগৃহে হররোজই কুইজ, বক্তৃতা, ইত্যাদি আয়োজিত হত এবং সেসব সকলের জন্যে খোলাছিল। মিউজিয়ামে গেলে মাঝে মধ্যেই তাঁর দেখাও হত।
কিন্তু আটের দশকের মাঝের থেকে বামরাজনীতি, তারপরে কলকাতা ছাড়া আবার নয়ের দশকের মাঝামাঝি কলকাতা ফেরা, হকার আন্দোলনে যোগ দেওয়ার চক্করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় হারিয়ে যায়। দু’একবার নাম মাত্র দেখা হয়েছিল ফার্নরোডে সতীববাবুর বড়িতে। সতীনবাবুর প্রবন্ধ সমগ্র প্রকাশ করার কাজের বাহানার। মনে হয়না সেসময় আমার সঙ্গে সমর বাবুরখুব একটা উল্লেখযোগ্য কিছু আদান প্রদান হয়েছিল – কিছুই স্মরণ নেই।
এরপরে আমার হকার ইউনিয়ন জীবন। আন্দোলন সূত্রে শক্তিমান ঘোষ আর মেধা পাটকরের জোট তৈরি হল। হকার দিবসে শহীদ মিনারে মেধা একবার প্রধান বক্তাও ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে কয়েকবার দেখা। ব্যাস। কিন্তু ২০০৪এ হকার ইউনিয়ন ছেড়ে কারিগর সঙ্গঠন তৈরি করার মাঝের সময়ে হকার ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ কেটে যায়নি। সেই দশকের শেষের দিকে, বিশেষ করে ২০০৮এর অর্থনৈতিক বিশাল ধাক্কার সময় আমি কারিগর সঙ্গঠনে জুড়ে গিয়েছি। হকার কারিগর জোট তৈরি হয়েছে। জোটের বৈঠকে বেশ কয়েকবার নানান বাহানায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, আলোচনাও বেশ কয়েকবার হয়েছে।
হৃদ্যতা একই রকম থাকলেও সমস্যা দেখাগেল পথ নিয়ে। তত দিনের আমাদের দুজনের জ্ঞানচর্চার পথ আলাদা হয়ে গেছে। আমি হকার-কারিগরদের থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন পথে যাওয়ার চেষ্টা করছি; আমাদের দুই অসমবয়সী মানুষের তাত্ত্বিক রাস্তা, তত্ত্ব, তথ্য কোনও কিছুই মেলেনি।
আমরা ভদ্র বিত্ত প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান আন্দোলনের অসারতা স্পষ্ট ভাবে বুঝতাম। হকার সংগঠন করার সময় থেকেই বুঝতাম গত ৭০ বছর এই আন্দোলন আদতে উপনিবেশিক কাঠামো, কেন্দ্রি ভূত কর্পোরেট কাঠামোকে জোরদার করার কাজ করেছে । আমি, দীপঙ্করদে, মধু মঙ্গল মালাকার দেশ জপথের ভাবনা ভাবা, কারিগর ব্যবস্থা বিষয়ে গবেষণা এবং হাতে কলমে কাজ শুরু করেছিলাম। মাঝে মধ্যে সমর বাবুর দেখা হলেই পথ নিয়ে বিতর্ক হত। ঠিক যেমন ২০১৩য় এশিয়ান দেভেলাপমেন্ট ব্যাঙ্কের বাইনিয়ালের বিরুদ্ধে দিল্লির সম্মেলন স্থলে বাংলার কারিগর হাট দেখতে আসা সম্মেলনের দুই উদ্বোধক বিচারপতি সাচার বলেছিলেন এটাই কর্পোরেট বিরোধিতার রাস্তা, এই রাস্তায় এগোতে হবে আর অমিত ভাদুড়ি বলেছিলেন এসব ভুল ভাল কাজ করে কর্পোরেট দের হঠানো যাবেনা।কর্পোরেটদের রাস্তাতেই তাদের হঠাতে হবে।
দেশ কোন পথে যাবে সেই পথ বাছা নিয়েই সমর বাবুর সঙ্গে আমাদের, কারিগর সংগঠনের মতবিরোধ হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে তিনি বিচার পতি সাচার আর অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ির দেখানো পথের একটা মাঝামাঝি রাস্তা খোঁজার কথা ভাবতেন। আজ তাঁর স্মৃতিচারন করতে গিয়ে অনেকেই তাঁর গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ পথের অনুগামী তার কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা যেহেতু এই দুই মহাতেজের নিদান দেওয়া পথ সম্বন্ধে কিছুই জানিনা, তাই তার গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ পথের অনুগামী তার বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগ। আমার কেন যেন মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ যেমন গান্ধীর দেশকে চরকা ধরানোর রাস্তাকে অনুমোদন করেননি, মিলে কাপড় তৈরি হওয়ার পথকেই সমর্থন করেছেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গী সমরবাবুরও ছিল। সেপথ আমাদের ছিলনা, আজ ও নেই। বিদ্যুৎ ছাড়া যন্ত্রে আজও শ্রেষ্ঠ পণ্য তৈরি হয়।
দেশের বিকাশ পথের প্রযুক্তির চরিত্র বাছা নিয়ে দেখা হলেই বিতর্ক হয়েছে। মনে আছে ২০১৩-১৪য় আমরা কারিগর সংগঠনের পক্ষে পরম পত্রিকা করছি – বিশেষ করে লোহা ইসপাত সংখ্যা করার আগেই এনএপিএম এর বেলেঘাটায় কোনও একটা সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে দেখা। তখন আমরা জং ছাড়া ইসপাত বিষয়ে সংখ্যা করেছি। তিনি এ হেন বস্তুর অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুললেন।ভাদুড়ির রাস্তায় বললেন, এটা পথনয়। তিনি মনে করতেন মিলের ইস্পাতই শ্রেষ্ঠ – আর জং ছাড়া লোহা ইস্পাত উজ স্টিল বিষয়ে যা কিছু লেখা পত্র হয়েছে সেসব প্রশ্ন যোগ্য। কারন পশ্চিমি ধাতু বিদ্যার পাঠ্য পুস্তকে বাংলা, জয়ন্তীয়া পাহাড়, ছত্তিস গড় আর দক্ষিণের লোহা কম, বিশ্ব কর্মাদের জং ছাড়া লোহা তৈরি রযে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়েছে, বিশেষ করে আইআইটির এ কে বিশ্বাস বা ধরমপালের গবেষণাকে অস্বীকার করা হয়েছে। তিনি ও সেই পথের মানুষ ছিলেন। আমরা দেশ জজ্ঞান চর্চাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতাম।এ রকম বহু ক্ষেত্রেই আমাদের মতের, পথের তীব্র পার্থক্য হয়েছে। আমার মনে পড়ছে হিমাংশু হালদারের সঙ্গে জনস্বার্থ বার্তা পত্রিকা করার সময়ে ও বেশ কয়েকবার দেখা, আলোচনা হয়েছে। গত ১০ বছর আমাদের আর দেখা হয়নি।
তবু ও আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, গুরুতর মত পার্থক্য সত্ত্বে ও তিনি সেই আশির দশকে আমার ছাত্র জীবনে যেধরণের ভালবাসা দিয়েছেন, পরিণত যৌবনেও সেই স্নেহের ধারাবর্ষণ করতে বিন্দুমাত্র ও কুণ্ঠা দেখাননি। আমরা যে পথে চলেছি, তার বহু ক্ষেত্রে মতের পার্থক্য সত্ত্বেও সেই পথে যাওয়ার জন্যে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, আশীর্বাদ করেছেন। অভাবনীয় এই উদার মন আমায় আর্দ্র করে।
তাঁর পরিবেশ আন্দোলন, অধিকার রক্ষার আন্দোলন সবকিছুই আমাদের পাথেয় হয়ে থাকল। যে জ্ঞানচর্চার উচ্চতায় সমর বাগচী পৌঁছেছিলেন, সেই উচ্চতা থেকে পথের আন্দোলনের যোগ দেওয়াটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড। ঠিক সেই খোলা মননিয়েই তিনি এনআরসি-সিএএ বিরোধী মিছিলগুলোয় হাঁটতে না পারলে ও রাস্তার পাশে বসে গলা মিলিয়েছেন।
তিনি আজ নেই। তিনি এক ঈর্ষণীয় জীবনযাপন করেছেন – প্রতিষ্ঠানে এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তেই সমান ভাস্বর থেকেছেন। কিন্তু তার পথ আমাদের পাথেয় হয়ে থাকল।