
জিতেন নন্দীঃ ২০১০ সালের জুলাই মাসে UIDAI ১৫টি বেসরকারি এজেন্সিকে আধারের তালিকাভুক্তির প্রশিক্ষণের জন্য নিযুক্ত করে এবং তালিকাভুক্তির কাজের জন্য ২২০টা বেসরকারি এজেন্সির নাম প্রকাশ করে। এইভাবে প্রত্যেক ভারতবাসীকে এক অনন্য পরিচয়জ্ঞাপক সংখ্যা দেওয়ার প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ার সহ মোট ১৭ জন বিশিষ্ট মানুষ। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ তাঁদের লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করে এই প্রকল্প স্থগিত রাখতে বলা হয়। এতে বলা হয়, এই প্রকল্প নিয়ে এগোতে গেলে যে ত্রুটিগুলো দূর করা আবশ্যিক, তা হল :
ক) এই প্রকল্পের মাধ্যমে রেশন (PDS) ও ১০০ দিনের কাজ (NREGA) কর্মসূচির যথার্থ রূপায়ন করা যাবে বলে যে দাবি করা হয়েছিল, কীভাবে তা স্পষ্ট নয়। বরং এইসব কাজে আধারের তথ্য বহু জায়গায় অনেক লোকের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গোপনীয়তা লঙ্ঘন হতে পারে এবং তা ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
খ) UIDAI-এর হিসেব মতো প্রথম চার বছরে এই প্রকল্পে ৪৫,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। এই খরচ কতটা যুক্তিযুক্ত, তাও বিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি।
গ) Ernst & Young এবং Accenture–এর মতো কর্পোরেট বহুজাতিক কোম্পানিকে যুক্ত করা হয়েছে। তাহলে কারা এই তথ্য ব্যবহার করতে পারবে এবং ভারতবাসীর কাছে তার অর্থ কী?
ঘ) গোপনীয়তা, রাষ্ট্রের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকারের দিক থেকে এই প্রকল্প কতটা সংবিধান-সম্মত?
ঙ) একটা সরকারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্ল্যানিং কমিশনের সঙ্গে যুক্ত একটা দপ্তর হিসেবে UIDAI কাজ শুরু করে দিয়েছে, সংসদ এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে কোনো আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই। এই প্রক্রিয়া অগণতান্ত্রিক$।
চ) গোপনীয়তা, নজরদারি, ব্যক্তির জৈব-বৈশিষ্ট্যের নথিকরণ (profiling), অনুসরণ (tracking), আধার-তথ্যের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য একত্রিত করা (collate)
এর পাশাপাশি এই বিবৃতিতে এটাও উল্লেখ করা হয় যে আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ ব্যয়বহুলতা এবং গোপনীয়তার লঙ্ঘনের প্রশ্নে এই ধরনের জাতীয় পরিচয় নথি তৈরির কর্মসূচি বাতিল করেছে। এছাড়া এই প্রকল্প পাইলট স্টাডির পর্যায়ে রয়েছে। বায়োমেট্রিক পাইলট স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে আঙুলের ছাপ বিশেষত গরিবদের স্থিতিশীল নয়, ছানি এবং অপুষ্টির মতো কারণে চোখের ছবিও তাদের নির্ভরযোগ্য নয়।
কেন্দ্রীয় সরকার এই বিবৃতিতে উত্থাপিত বিষয়গুলিকে আমল দেয়নি$ অবশেষে বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার লেখেন : “আধার প্রকল্প কার্যকর করা উচিত নয়, কারণ এটা ব্যক্তির গোপনীয়তা ও মৌলিক অধিকারগুলোর ওপর আঘাত এবং এটা একটা ফ্যাসিস্ত দেশের পক্ষে মানানসই” [Aadhar : How a nation is deceived, 3 November 2011]
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট ২০১৯-এ বলা হয়েছে : “সবচেয়ে বড়ো তথ্য-ভঙ্গ হয়েছে ভারতে, সংবাদসূত্রে জানা গেছে, ওখানে সরকারি আইডি তথ্যভাণ্ডার , আধার থেকে বহু তথ্য-ভঙ্গ হয়েছে। জানা গেছে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে অপরাধীরা ১০ মিনিট তথ্যভাণ্ডার পাঁচশো টাকায় বিক্রি করেছে, মার্চ মাসে একটা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থায় লিক হওয়ার ফলে যে কোনো লোককে নাম ও আইডি নাম্বার ডাউনলোড করতে দিয়েছে।”
তথ্য-ভঙ্গ বা তথ্যচুরির সবচেয়ে সর্বনাশা ঘটনা ঘটছে আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। ঐচ্ছিক হওয়া সত্ত্বে ব্যাঙ্কে আমরা আমাদের আধার নাম্বার দিতে বাধ্য হয়েছি। আধার-কর্তৃপক্ষ আধার-তথ্যের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য একত্রিত করেছে; আমাদের যাবতীয় নথি-দলিলপত্র-তথ্য একত্রিত করেছে; তৈরি করেছে প্রত্যেক দেশবাসীর সামগ্রিক তথ্যভাণ্ডার। যদি সামান্য হ্যাকাররা পাঁচশো টাকায় তথ্য কেনাবেচা করতে পারে, তাহলে গ্লোবাল কর্পোরেট কোম্পানিরা কী করে চলেছে অনুমান করুন। এ হল নজরদারির পুঁজিবাদ।