
তাপস মহাপাত্র : অনেকেই মনে করেন বাঙালির দুটো সেরা উৎসব। একটি দুর্গাপুজো অন্যটি কলকাতা বইমেলা। এবছর আবার কলকাতা বইমেলাকে কেউ কেউ মহাকুম্ভের সঙ্গেও তুলনা করছেন। বাঙালিরা বরাবরই আবেগ প্রবণ, হয়তো তাই সাহিত্যের প্রতি যথেষ্ট টান, সংস্কৃতিবান। বলাবাহুল্য, এই শ্রেণির বাঙালির কাছে বইমেলা একটা বিশেষ জায়গা নিয়েই থাকবে এটাই সত্য। তবে এই বিশেষ জায়গার অধিকাংশটাই যে আবেগ দিয়ে ভরা তা বইমেলায় গেলেই বোঝা যায়।
বাঙালির এই আবেগকে শীত বসন্তের মাঝখানে ফি বছর দশ বারো দিন এক জায়গায় জড়ো করে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলার আকার দেওয়ার পিছনে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড-এর কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। এটা সত্যি, এর পিছনে রয়েছে প্রকাশকদের একটি গোষ্ঠীর দুরন্ত প্রচেষ্টা, শ্রম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা। যদিও তা একদিনে হয়নি। আজকের কলকাতা বইমেলার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। তা যেমন গর্বের, তেমনি লড়াইয়েরও। বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে এখনকার বইমেলার এই চেহার, ঐতিহ্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা।
এত সবের পর, তবুও জিজ্ঞাসা- এত ঢাকঢোল, এত আড়ম্বরের সঙ্গে ১০-১২ দিন ধরে চলা এই মেলার সার্থকতা কোথায় ? এবারও হাজারের উপর বইর স্টল, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আছে শ’ দুয়েক টেবিল। ফুড ক্যাফে ও অন্যান্য বিপনির কথা ছেড়েই দিলাম। এতবড় আয়োজন, যা বিশ্বের আর কোথায় মেলে না, তা সত্ত্বেও কেন বাংলার প্রকাশনার ক্ষেত্রটি কুটিরশিল্পে থেকে গেল ? গলদটা ঠিক কোথায় ?
মনে পড়ে যায় স্ট্যানলি আনউইনের কথা। ১৯১৪ সালে, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের মধ্যে ইংল্যান্ডে শুরু করেছিলেন তার প্রকাশনা সংস্থা- জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, যা পরে অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন নামে খ্যাত। বার্ট্রান্ড রাসেল, সিডনি ওয়েব, আর এইচ টাউন এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো লেখকদের বই প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সাহসিকতা, সম্পাদনার ক্ষেত্রে অসীম দক্ষতা, কন্টেন্ট পরিকল্পনা এবং লেখক-প্রকাশক সম্পর্কে উপলব্ধি তাঁকে কিংবদন্তি করে রেখেছে প্রকাশনা-বিশ্বে। তাই আজও প্রকাশনা জগতে ‘গীতা’ হয়ে আছে তাঁর বই, দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট পাবলিশিং। যেখানে তিনি প্রকাশকের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে এক কঠিন সত্যকে তুলে ধরেছেন। যা হল- সীমিত ক্ষমতার মধ্যে বুক ভরা সাহস। যা হল- প্রকাশকরা জনসেবা করতে আসেনি, আবার দুর্বৃত্ত নয়। তারা বিশাল ধনী নয় আবার ভিখিরিও নয়। যে সত্য থেকে সরে যাচ্ছে আজকের প্রকাশনা জগত। আমাদের হাতের কাছে অতি চেনা কলকাতার বইবাজারের দিকে তাকালে দেখা যাবে এই অতিকঠিন রুটিরুজির সন্ধানে আসা লেখকদের কাছে প্রকাশদের ভূমিকায় দুর্বিত্তায়ন ঘটছে, আবেগ হয়ে যাচ্ছে প্রতারণার ইন্ধন। প্রকাশনায় ঢুকে পড়েছে অসাধু চক্রের হাবভাব। এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলা প্রকাশনার বড় শিল্প হয়ে ওঠার স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা।
প্রকাশনাকে বড় শিল্প করে তুলতে গেলে সবার আগে ভাবতে হবে তার প্রডাক্ট নিয়ে। ভাবতে হবে, কী ভাবে একটি বইকে পণ্য করে তুলতে হয়। তার জন্য সবার আগে আসে কন্টেন্ট, এখানেই দরকার প্রকাশকের দক্ষতা, বাজার সম্পর্কে বিচক্ষণতা, পাঠকের প্রকৃত পছন্দ। এর থেকে কি বেরিয়ে যাচ্ছে না এখনকার প্রকাশনা ব্যবসা ? তাঁরা দোষ দিচ্ছেন পাঠককে, বলছেন, বই বিক্রির ঘাটতির কথা। কিন্তু এটাই কি বাংলা বইর বাজার মন্দার হাওয়ার আসল কারণ ? তাই শুধু মেলা করে বিশেষ উন্নতি হবে না, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলারস গিল্ডকে নজর দিতে হবে এর আদর্শগত দিকে। প্রকাশকদের সচেতন করতে হবে। নাহলে বইর নামে আগাছায় ভরবে বইমেলার হাজার স্টল। যা প্রকারান্তরে বইমেলার উদ্দেশ্যকে নষ্ট করবে।