
ওঙ্কার ডেস্ক: পশ্চিম এশিয়ার আকাশ জুড়ে আবার বারুদের গন্ধ। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার অভিযোগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইজ়রায়েলের ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ কার্যত চমকে দিয়েছে ইরানকে। পরমাণু কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটিতে একযোগে আক্রমণে নিহত হয়েছেন ইরান সেনার উচ্চপদস্থ অফিসার ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এটা কি শুধুই ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার চেষ্টায় ? না কি এর পিছনে আছে আরও গভীর কূটনৈতিক খেলা ?
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা ছড়ায় IAEA-র রিপোর্ট ঘিরে, যেখানে জানানো হয় ইরান আন্তর্জাতিক নিয়ম ভেঙে ইউরেনিয়াম সঞ্চয় করছে। পুর্বে ইজরাইল গাজার উপর হামালা করার পর থেকেই ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে আরও অবনতি ঘটে। আর IAEA-র রিপোর্ট ঘিরেই হামলার জিগির তোলে ইজ়রায়েল। সামরিক দিক থেকে কার্যকর হলেও, হামলার সময়টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই রবিবারই ওয়াশিংটন-তেহরান পরমাণু চুক্তি নিয়ে ষষ্ঠ দফার আলোচনার দিন স্থির করা হয়েছিল।
এই হামলায় ইজ়রায়েল ইরানের মোট ৬ টি জায়গায় আক্রমণ চালায়। প্রায় ৩০০টির বেশি বোমাবর্ষণ করা হয় ইরানের মাটিতে। প্রথমে রাজধানী তেহরান ও পরবর্তীতে তাবরিজ, নেতানজ, ইশফাহান, আরাকের পারমানবিক কেন্দ্রে হামালা চালায়। কারমেনশাহতে ইরানের মিশাইল বেসেও আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণ ইরানেকে রাজনৈতিক ও সামরিক স্তরে ব্যাপকভাবে ক্ষতি করেছে। হামলায় প্রাণ হারিয়েছন মেজর জেনারেল হোসেন সালামি, মহম্মদ বাঘেরি, গোলাম আলি রাশিদ সহ বহু পরমানু বিজ্ঞানী। মেজর জেনারেল হোসেন সালামি ইজরায়িলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা ব্যথার কারণ ছিল।
ট্রাম্পের দ্বিচারিতা ও রাজনৈতিক চাপের যথেষ্ট ভূমিকা আছে এই পরিস্থিতির জন্য। উল্লেখযোগ্য ভাবে, ওবামা-জমানায় ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষর হওয়া পারমানবিক চুক্তি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে নিজেই বাতিল করেছিলেন আর এখন সেই চুক্তিতে ফেরাতে চাপ দিচ্ছেন ইরানকে। হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন, না মানলে আরও ভয়াবহ হামলা আসবে। ধুলোয় মিশে যাবে ইরান এমনও সুর চড়িয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। IAEA-র রিপোর্ট বের করার পর থেকেই ইজরায়িল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ট্রাম্প শুরু থেকেই দুই দেশকেই যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই মার্কিন যুক্তরাষ্টের যুদ্ধ বিমানে করেই ইরানের উপর হামলা করে নেতানিয়াহু। এই হামলাকে ট্রাম্প পরোক্ষভাবে সমর্থন করলেও যুক্তরাষ্টের সেক্রেটারি অব স্টেট মারকো রুবিও এই হামলার সঙ্গে আমেরিকার কোনোরকম যোগসুত্র অস্বীকার করেছেন। তিনি ইরানে থাকা তাঁদের সামরিক ঘাঁটির সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত। মারকো রীতিমত ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নজর না দেওয়ায় শ্রেয়।
ইজ়রায়েলি হামলার জবাবে ইরান শুধু কূটনৈতিক ভাষায় নয়, সরাসরি সামরিকভাবে পাল্টা দিয়েছে। কোমের জামকারান মসজিদের চূড়ায় উত্তোলিত লাল পতাকা ইরানের যুদ্ধের ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়েছিল। ইরানের উপর হামলার জবাবে শনিবার ভোর রাতে ইরান ১০০-র বেশি ক্ষেপনাস্ত্র চালায় ইজরায়েল উপর। ইজরাইলের আকাশ নিরাপত্তা সুকাঠামো হওয়ায় তেমন ক্ষতি করতে পারেনি এই ক্ষেপনাস্ত্র। তারপর আবারও তেহরান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বোমাবর্ষণ করে ইজরায়িল।
তেহরান দাবি করে বলেছিল, মজুত করা ইউরেনিয়াম বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অসামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করে তারা। ৬০ শতাংশ শুদ্ধ ইউরেনিয়াম সঞ্চিত করা আছে তাদের কাছে। তথ্য অনুযায়ী ৯০ শতাংশ শুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে। ৪২ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ শুদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়েও সীমিত পরমাণু অস্ত্র তৈরি সম্ভব এই ভয়েই কাঁপছে পশ্চিম। তার জেরে এই হামলা।
পশ্চিম এশিয়ায় দেশ গুলির সঙ্গে ইরানের ভারসাম্য ও ইরানের অর্থনৈতিক দুর্বলতা, এই সময়কেই হামালার উপযুক্ত সময় হিসাবে বেছে নিয়েছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস, ইয়েমেনের হুথি, সিরিয়ার আসাদ সরকার, সব জায়গাতেই ইরানের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। উপরিউক্ত ঘটনা ও সৌদি-ইজ়রায়েল-মার্কিন ঘনিষ্ঠতা ইরানকে কোণঠাসা করে তুলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে।
যুদ্ধের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে দুই দেশের তরফে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আপাতত কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করে ইরানকে পরমাণু চুক্তিতে ফিরিয়ে আনতে চায়। আর ইরানও বোঝে, পুরোপুরি যুদ্ধ মানেই চূড়ান্ত ধ্বংস। ইজ়রায়েলি হামলা সামরিক দিক থেকে যতটা তাৎপর্যপূর্ণ, কূটনৈতিক দিক থেকে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরমাণু অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও ইরান এই সংঘাতে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এই আবহেই ট্রাম্পের দ্বৈত ভূমিকা, পশ্চিম এশিয়ার নতুন জোটবদ্ধতা এবং ভূ-রাজনীতির ভারসাম্য বিশ্বকে নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে।