
ও পি শাহ্ : সম্প্রতি দিল্লিতে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশের মধ্যে দেখা গেল স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার এবং উন্নত করার এক বিরল মিথস্ক্রিয়া। এর জন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে দুই প্রতিবেশী দেশের কিছু বিশিষ্ট কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ এবং শান্তিকর্মীদের মধ্যে জুম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটি আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। দু ঘন্টারও বেশি এই আলোচনা পর্বে উঠে এল দু দেশের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ও তার উন্নতি নিয়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ভারতের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি শ্রী হামিদ আনসারির লেখা “ইন পারস্যুট অফ পিস : ইমপ্রুভিং ইন্দো-পাক রিলেশনস (দ্বিতীয় খণ্ড)” নামক একটি অনন্য বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি-র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হিসেবে আমি এই আলোচনার আয়োজন করেছিলাম।
সেই আলোচনা সভায় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়ে শ্রী আনসারি উল্লেখ করেন, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কেবল রাজনৈতিক সম্পর্কই নয়, বরং মানবিক সম্পর্কও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে উভয় দেশের লেখক এবং এর সম্পাদক ওপি শাহের ৫২টি প্রবন্ধ এবং প্রবন্ধ সম্বলিত বইটির প্রশংসা করেন। তিনি জানান, এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির সন্ধানে একটি অসাধারণ অবদান।
এখানে বলে রাখি, চার বছর আগে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর, পরের সংস্করণের জন্য লেখা দিয়েছিলেন ৫২ জন বিশিষ্ট লেখক। যাঁরা নিরলস ভাবে এই বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। তাঁরা সকলেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। যদিও মতামতের পার্থক্য শুধু একটি জায়গায়- এটা কীভাবে অর্জন করা যায় সে সম্পর্কে সকলের ধারণার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ লক্ষ্য করা গেল।
ভারত ও পাকিস্তানকে সমঝোতার কাছাকাছি আনার ক্ষেত্রে প্রয়াত রাষ্ট্রদূত সতীন্দর কুমার লাম্বার ভূমিকার প্রশংসা করেন শ্রী আনসারি। তিনি বলেন, দুই দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য একমত হওয়ার পর প্রস্তুত করা হয়েছিল, কাগজপত্র। তাতে দু’ পক্ষের সই করার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। প্রধান বিচারপতি এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে একটি অপ্রীতিকর সংঘর্ষের ফলে তা আটকে যায়। অনুষ্ঠানের শেষে বক্তব্য রাখেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ ফারুক আবদুল্লাহ। তিনি দু’ দেশের মধ্যে তিক্ততা মুছে ফেলার কথা বলেন। তাঁর কথায়, ভারত ও পাকিস্তান এক মত হওয়ার পরও অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রায়শই এই বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে। তাঁর কথায়, এটি আঞ্চলিক পরিবর্তন নয় বরং একে অপরের প্রতি হৃদয়ের পরিবর্তনই গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রী আনসারি এবং ডঃ আবদুল্লাহর বক্তব্যের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভারতীয় ও পাকিস্তানি চিন্তাবিদ দুই দেশের মধ্যে সংলাপ পুনরায় শুরু করার বিষয়ে সহমত হন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ উপস্থিতদের মনে করিয়ে দেন যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনও কূটনৈতিক যোগাযোগ, সংলাপ বা আলোচনা থেকে বিরত থাকেনি।
এই বইটিতে পাকিস্তানের প্রাক্তন ফেডারেল মন্ত্রী জাভেদ জব্বারের বিশেষ অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিনিময় এবং সংলাপের অনিবার্যতার উপর জোর দিয়েছিলেন, তার প্রমাণ রয়েছে অতীতের বেশ কয়েকটি আলোচনায়। তিনি কূটনৈতিক ভাবে বা নেপথ্য থেকে বা কোন দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব জলিল আব্বাস জিলানির কথা বলতে হয়। যিনি কয়েক মাস ধরে এবং গত বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। জিলানি দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন, সীমান্তের উভয় পাশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্য তাঁদের কথা শুনতে হবে, সাড়াও দিতে হবে।
পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন বক্তা দু’ দেশের সম্পর্কে উন্নতির লক্ষ্যে ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং প্রাক্তন কূটনীতিক মণি শঙ্কর আইয়ারের ভূমিকার প্রশংসা করেন। আইয়ার নিজেও একই সংকল্প এবং এর অপরিহার্যতার কথা বারবার বলেছেন। এখনও পর্যন্ত উন্নতির জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারত-পাক সম্পর্কের খরা কাটেনি বলে জানিয়েছেন মণি শঙ্কর আইয়ার।
ভারত-পাক সম্পর্কের শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য রাখেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার ভাইস-মার্শাল কপিল কাক। তিনি বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘ শত্রুতা এবং শীতলতার কারণে মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
সাউথ এশিয়া ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (SAFMA) এর প্রধান, এবং পাকিস্তানের প্রবীণ সাংবাদিক ইমতিয়াজ আলম সার্ক পুনরায় চালু করার জন্য জোরালো আবেদন করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি দুই দেশ একে অপরের দেশে সম্মেলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে, তাহলে তারা তৃতীয় স্থান বেছে নিতে পারে, যেমনটি বর্তমান ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সার্কের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানকে দুবাই পর্যন্ত যেতে হবে না কারণ ভারত ও পাকিস্তান ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক হতে পারে।
এদিন এই প্রাণবন্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়া, প্রাক্তন র-প্রধান এএস দুলাত, ভারতীয় সাংবাদিক কুরবান আলী, পাকিস্তানের বিখ্যাত নাট্যকার শহীদ নাদিম এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিক নেতা স্বামী সুশীল গোস্বামী।
ভারতে পাকিস্তানের বর্তমান চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স সাদ আহমেদ ওয়ারাইচ আলোচনায় বসেছিলেন, যা আইআইসির এই নির্বাচিত সমাবেশ মনোযোগ সহকারে শুনেছিল। সীমান্তের ওপার থেকে অংশগ্রহণকারীদের এই বিরল কথোপকথনের শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন লেখক ও সাংবাদিক রোহনি সিং।