
স্পোর্টস ডেস্ক :আইএসএল শিল্ডের পরে এ বার কাপও জিতে নিল তাঁর দল। দ্বিমুকুট জিতে তারা গড়ল ঐতিহাসিক মাইলফলক। এই অসাধারণ সাফল্যের পরেও একেবারেই স্বাভাবিক মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হেড কোচ হোসে মোলিনা। বাড়তি উচ্ছ্বাস বা উত্তেজনা কোনওটাই নেই তাঁর গলায়।
ম্যাচের পরে সাংবাদিকদের কোচ বলেন, “এক গোল খাওয়ার পরেও খেলোয়াড়দের সবাইকে বলেছিলাম, মাথা ঠাণ্ডা রাখো এবং খেলাটা উপভোগ করো। নিজেদের প্রতি আস্থা বজায় রাখো। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখো এবং শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাও। তা ওরা করতে পেরেছে বলেই সুফল পেয়েছি। ডুরান্ড ফাইনালে হারার পরে নিজেদের ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলাম সবাইকে। দল তৈরির প্রক্রিয়ার ওপর বিশ্বাস রাখা খুব দরকার। সেটা আমরা সবাই করতে পেরেছি বলেই আজকের এই সাফল্য পেলাম”।
শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বেঙ্গালুরু এফসি-কে ২-১-এ হারিয়ে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দ্বিমুকুট জিতে নেয় কলকাতার সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। নির্ধারিত সময়ে ফল ১-১ থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে জয়সূচক গোল করে লিগের ইতিহাসে এই প্রথম দ্বিমুকুট জেতে হোসে মোলিনার দল। দেড় মাস আগেই লিগশিল্ড জিতে নিয়েছিল তারা। এ বার কাপও জিতে নেয় তারা। ফলে ভারতীয় ফুটবলে তৈরি হয় এক নতুন ঐতিহাসিক মাইলফলক।
এই মাইলফলক প্রতিষ্ঠা করার পর ড্রেসিংরুমে সেলিব্রেশন সেরে এসে মোলিনা বলেন, “কোচিং জীবনে এটাই আমার সেরা সময় কি না জানি না। প্রতি দিনই আমি শিখি, কোচ হিসেবে নিজেক উন্নত করে তোলার চেষ্টা করি। তবে আমি আশা করি, ভবিষ্যতে আরও ভাল কোচ হয়ে উঠতে পারব, আরও ভাল সাফল্য অর্জন করব। জানি না আমার কোচিংয়ে এটাই সবচেয়ে দাপুটে দল কি না। আমি হংকংয়ে ছিলাম এক বছর। সেখানে তিনটি ট্রফি জিতেছিলাম। আসলে আমি সব কিছুর মধ্যে তুলনা করি না। হলেও কিছু আসে যায় না। তবে আইএসএল শিল্ড ও কাপ জয় অবশ্যই বড় সাফল্য। সে জন্য আমি খুশি। দলের সতীর্থদের সবাইকে সে জন্য ধন্যবাদ”।
শনিবার ঘরের মাঠে নির্ধারিত সময়ের প্রথমার্ধে বেঙ্গালুরু এফসি আধিপত্য বিস্তার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় ফিরে আসে মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ৪৯ মিনিটের মাথায় আলবার্তো রড্রিগেজের নিজগোলে এগিয়ে যায় বেঙ্গালুরু এফসি। ৭২ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি থেকে সেই গোল শোধ করে সবুজ-মেরুন বাহিনীর অস্ট্রেলিয়ান তারকা জেসন কামিংস। অতিরিক্ত সময়ে ছ’মিনিটের মাথায় আর এক অজি তারকা জেমি ম্যাকলারেনের গোলে শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক খেতাব জেতে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ক্লাব।
প্রতিপক্ষের প্রথমার্ধের দাপট ও পরে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে মোলিনা বলেন, “বেঙ্গালুরুর মূলত পজেশন নির্ভর ফুটবল খেলে। তাই ওদের ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ থাকে বেশি। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের অর্ধে ও ফাইনাল থার্ডে বেশি তৎপর থাকতে পছন্দ করে এবং আমার কাছে সেটাই ভাল। ওদের বিরুদ্ধে আমরা এ মরশুমে চারটে ম্যচ খেলেছি। ডুরান্ড কাপের সেমিফাইনালে আমরা ওদের বিরুদ্ধে পেনাল্টি শুট আউটে জিতেছিলাম।
আইএসএলে ওদের মাঠে গিয়ে হেরে যাই এবং শেষ দুটো ম্যাচে জিতলাম। কোনও দলই সব ম্যাচ একই রকম ভাবে খেলতে পারে না। আমরাও সব ম্যাচে সমান ভাল বা খারাপ খেলি না। আমাদের দলে নগুয়েরা, পেদ্রো কাপোর মতো খেলোয়াড় নেই। তাই মাঝমাঠে আমাদের কিছুটা দুর্বলতা আছেই। কিন্তু আক্রমণে আমাদের মতো বিপজ্জনক আর কেউ নেই। এই জায়গাতেই ওদের সঙ্গে আমাদের তফাৎ”।
এদিন দলের দুই নির্ভরযোগ্য তারকা লিস্টন কোলাসো ও অনিরুদ্ধ থাপার পারফরম্যান্স অনেকেরই পছন্দ হয়নি। তবে মোলিনা অন্য কথা বলেন। তাঁর মতে, “লিস্টন ও থাপা তো ভালই খেলেছে। আজকের ম্যাচ সহজ ছিল না। কারণ, প্রতিপক্ষ বেশ কঠিন ছিল। তবে ওদের আজ কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল। তবে আমাদের অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় আছে। সহাল, আশিককে সেই জন্যই নামাই। ওরা যথেষ্ট ভাল করেছে। যে জন্য ওদের নামানো হয়েছিল, ওরা তা-ই করেছে। রক্ষণে আমরা কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি”।
সাফল্যের রহস্য নিয়ে জানতে চাইলে মোহনবাগান কোচ বলেন, “কোনও রহস্য নেই। যত পারো পরিশ্রম করো এবং সবাই মিলে পরিশ্রম করো। সমর্থক থেকে শুরু করে ক্লাবের ম্যানেজার সবাই যদি পরিশ্রম করে, তা হলে সুফল আসবেই। তা সত্ত্বেও কেউ নিশ্চিত হতে পারে না যে সে প্রতি ম্যাচে জিততে পারবে। আমরা মরশুম শুরুর আগে কখনও ভাবতে পারিনি যে আমরা কাপ, শিল্ড দুটোই জিতব। আসল কথা হল ফুটবলটা উপভোগ করা। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার”।
বেঙ্গালুরুর কোচ ম্যাচ হারার পর একাধিক অভিযোগ করে গেলেও মোলিনা জানান কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই তাঁর। বলেন, “হেরে গেলে আমি কখনও অজুহাত দিই না। বেঙ্গালুরুতে তিন গোলে হেরেছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও অজুহাত দিইনি। জামশেদপুরের বিরুদ্ধে প্রথম সেমিফাইনালে হারার পরেও কিছু বলিনি। কারণ, যদি অপ্রিয় কিছু হয়ে থাকে, তা হলে তা ফুটবলেরই অঙ্গ। কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই আমার। অন্যরা কে কী অভিযোগ করল, তা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না”।
প্রচুর অর্থব্যয়ে দল গড়েছে বলেই তাদের সাফল্য এসেছে, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নন মোলিনা। তিনি বলেন, “ইংল্যান্ডে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি প্রচুর অর্থ খরচ করে তাদের দল বানায়। কিন্তু সেই জন্যই যে তারা সফল হয়, তা বলা যায় না। অর্থই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি ওয়েন কোইলকে বলতে শুনেছি, মোহনবাগান ক্লাবের মতো বাজেট থাকলে প্রতি মরশুমে চ্যাম্পিয়ন করতে পারতেন তার ক্লাবকে। কিন্তু সেই বাজেট তাদের নেই কেন? আমি অন্য কোচদের শ্রদ্ধা করি। প্রতি কোচেরই নিজস্ব স্টাইল থাকে, আমারও আছে। সেই অনুযায়ীই কাজ করে যাব”।
দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে স্প্যানিশ কোচ বলেন, “আমি আমার নিজের মতোই থাকি। আমি জানি, দলের সব খেলোয়াড়কে আমি খুশি করতে পারব না। কারণ, সবাই তো আর খেলার সুযোগ পায় না। ১১ জন আর বড়জোর আরও পাঁচজন খেলতে পারে। দলের খেলোয়াড়দের আমি তাদের সেরা জায়গায় যেতে সাহায্য করি, যাতে তারা যে কোনও সময় মাঠে নেমে ভাল খেলতে পারে। সবার কাছেই আমি স্বচ্ছ্বতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। আমার সিদ্ধান্তের পিছনে যে যুক্তি থাকে, তা সবাইকে জানিয়ে দিই।
যদি কেউ আমার সঙ্গে একমত না হয়, তা হলে তাকে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝানোর চেষ্টা করি। তারা আমার কথা বোঝার চেষ্টাও করে। যেমন দিমি। আমি জানি, ও আমার প্রতি খুশি নয়। কারণ ওকে আমি অতিরিক্ত সময়ে নামাই। কুড়ি মিনিট মাঠে ছিল ও। তবে যতটুকু মাঠে ছিল, ততটুকুই খুব ভাল খেলেছে। প্রত্যেকের কাছেই আমি এটাই প্রত্যাশা করি। কেউ আমাকে নিয়ে খুশি থাকুক বা না থাকুক, আমি কিন্তু সবাইকে নিয়ে খুশি”।
পরের মরশুমেও মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কোচ থাকছেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, “শিল্ড জেতার পরেই আমি বলেছিলাম ক্লাবের সঙ্গে আমার এক বছরের চুক্তি রয়েছে। কিন্তু যদি শিল্ড বা কাপ জিতি, তা হলে চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়তে পারে। এখন আমাকে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসতে হবে। তারা যদি আমাকে থেকে যেতে বলে, থাকব। না চাইলে থাকব না”।
তবে পরের মরশুম যে আরও কঠিন হতে চলেছে, এই নিয়ে তিনি নিশ্চিত। মোলিনা বলেন, “পরের মরশুম আরও কঠিন হবে। পরের মারশুমে আরও ভাল খেলতে হবে আমাদের। আইএসএলে প্রতিটা ম্যাচ কঠিন হয়। আমি যদি এখানে থাকি, তা হলে একই নীতিতে কাজ করব এবং খেলোয়াড়দের একই ভাবে প্রশিক্ষণ দেব। সমর্থকদের খুশি করার জন্য তো যা করা দরকার, করতেই হবে”।