
সুরজিৎ দাস, নদিয়া : পড়ানোর পাঠ ফেলে একদিন যিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, আজ তিনিই রাষ্ট্রসঙ্ঘের কুর্নিশপ্রাপ্ত শান্তিরক্ষী। নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাসের বাসিন্দা অরুণাভ মুখোপাধ্যায়ের সাহস ও নিপুণতায় কাঁপছে কঙ্গোর জঙ্গি গোষ্ঠী। আর তাঁর মানবিকতায় উজ্জ্বল মানবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে এক বঙ্গসন্তান।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে এক সময় যোগ দিয়েছিলেন বিএসএফে। আজ তিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনের গর্ব। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোতে শান্তি ফেরানোর অভিযানে অসাধারণ ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘পিস কিপিং মেডেল’ উঠল তাঁর হাতে। এক বছরের বেশি সময় ধরে কঙ্গোয় শান্তিরক্ষার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন অরুণাভ। বন্দুক হাতে যেমন দক্ষ যোদ্ধা, তেমনই খাদ্য, ওষুধ পৌঁছে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সহানুভূতির দূত।
২০২৪ সালের মে মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে কঙ্গোতে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতীয় বিএসএফের ১৬০ সদস্যের বিশেষ দল। ২১ জন মহিলা জওয়ান-সহ সেই দলে ছিলেন অরুণাভও। কঙ্গোর এম-২৩ জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিয়ে পরপর সাফল্য এনে দিয়েছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে পিছিয়ে গেছে ভয়ঙ্কর সশস্ত্র সংগঠন। সাধারণ মানুষের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে এলাকায় ফেরানো হয়েছে শান্তির নিশান।
ফোনে আনন্দবিহ্বল অরুণাভ বলেন, “আমরা এখানে শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছি না, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক মহৎ দায়িত্ব পালন করছি। খাদ্য, ওষুধ, মানবাধিকার—সবচেয়ে জরুরি জিনিসগুলো পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
নদীয়ার বুক গর্বে ভরে উঠেছে তাঁর এই কৃতিত্বে। শিবনিবাসের এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিবমন্দিরের সামনে বাড়ি অরুণাভর। বাবা অমিতাভ মুখোপাধ্যায় সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। পরে বিএসএফে ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। পিতার পথেই পা রেখে অরুণাভও আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল করেছেন নিজের পরিচয়।
কঙ্গোর সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক প্রাচীন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে আদিজনজাতির বসবাস। ১৯৬০ সালে ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেলেও শান্তির মুখ দেখেনি দেশটি। বারবার জর্জরিত হয়েছে বিদেশি আগ্রাসনে। দেশের অভ্যন্তরেও জঙ্গিদের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত জীবনযাত্রা। আর এর মূলে রয়েছে সে দেশের মাটির তলায় লুকোনো বহুমূল্য খনিজ সম্পদ, যার ওপর চোখ পশ্চিমা বিশ্বের।
এই পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ভারতের তরফে গিয়েছিলেন অরুণাভ। তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী শুধু অস্ত্রের জোরে নয়, মানবিকতায় জয় করেছে সাধারণ মানুষের মন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অরুণাভর এই স্বীকৃতি নতুন প্রেরণা জোগাবে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর কর্মীদের। বঙ্গসন্তানের এই জয় যেন আরও একবার মনে করিয়ে দেয়—যুদ্ধের মধ্যেও জন্ম নিতে পারে শান্তির আলো।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘পিস কিপিং মেডেল’—এ এক অনন্য সম্মান। আর তাতে লেগে রয়েছে রয়েছে নদীয়ার মাটির গন্ধ।