
ওঙ্কার ডেস্ক: লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বিরোধিতায় নামে কংগ্রেস সহ বিজেপি বিরোধী শিবির। যদিও বিলটি সংসদের উভয় কক্ষে পাশ করিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সংশয় ছিল না কেন্দ্রের। অঙ্কের হিসেবে তা প্রথম থেকেই সুনিশ্চিত ছিল। তবু সর্বসম্মত ভাবে এই বিলটি পাশ করানোর জন্য একটা দীর্ঘ প্রচেষ্টা চলেছিল কেন্দ্রের তরফে। কারেওণটাও যে রাজনৈতিক তা বিলক্ষণ বোঝা যায়। তবু বিরোধীরা যে বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার কি ভাগাভাগির পথে যেতে চাইছে ? আসলে তা কেন ? বিষয়টি শুধুমাত্র রাজনৈতি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর আসল প্রকৃতি বোঝা যাবে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অপ্রকাশিত জগত, যেখানে সম্ভবত লুকিয়ে আছে অধিকার এবং ক্ষমতা। তাহলে কী ওয়াকফ সম্পত্তিকে ঘিরে যে বলয় গড়ে উঠেছে তা কী “তাঁর নামে আমার” জগত ! কী আছে এই ওয়াকফ-এ, যাতে গেল গেল রব উঠল দেশ জুড়ে ! “সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত” বলে বিরোধীরা যে অবস্থা নিতে চাইছে তার পিছনে রাজনৈতিক হিসেব থাকলেও, বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক নয়। তাহলে কি ?
ওয়াকফ হল দানের সম্পত্তি। এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভাল করার জন্য প্রতিটি রাজ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ওয়াকফ বোর্ড। যেখানে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও অপব্যবহার রোখার বিভিন্ন আইনবিধি রয়েছে। যা কার্যকর হয়েছে ১৯১৩ সাল থেকে ওয়াকফ আইনের মাধ্যমে। প্রতি জেলায় ওয়াকফ বোর্ডগুলি ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে হওয়া আয়ের হিসাব ও তাদের মধ্যে উন্নয়নের খাতে সেই টাকার ব্যবহার এবং প্রাপ্য করের হিসাব রাখে।
ইতিমধ্যেই সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে যাওয়ার পর বহু চর্চিত-বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের বর্তমান গন্তব্য রাষ্ট্রপতি ভবন। সেখানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সিল-স্বাক্ষর হলেই তা আইনে পরিণত হয়ে যাবে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে এত বিতর্কের কারণ কি ? কেনই বা শাসকদল বিজেপি এই বিলকে আইনে কার্যকর করতে চাইছে ? আর কেনই বা বিরোধী জোট সর্বশক্তি দিয়ে এই বিলের বিরোধিতা করে চলেছে। আইনসভায় পাশ হয়ে যাওয়ার পরেও বিচারসভায় বিলকে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর হয়েছে কংগ্রেস এবং ডিএমকে। কী উদ্দেশ্য রয়েছে এর পিছনে ?
সংসদে ওয়াকফ সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক ওয়াকফ ইতিহাস নিয়ে একটি বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। যেখানে ওয়াকফের মূল সম্পত্তি ছাড়াও কোন রাজ্যে কত পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তার তথ্য দেওয়া আছে। যে তালিকা অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যার শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ এবং দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
২০২৫ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত দেওয়া পরিসংখ্যানে দেশে মোট ৮.৭২ লক্ষ নথিভুক্ত ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। জমির হিসেবে যার পরিমাণ ৩৮ লক্ষ একর। ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম অফ ইন্ডিয়া পোর্টালেই এই ডেটা রয়েছে। এর মধ্যে ৪.০২টি ওয়াকফ সম্পত্তিতে ব্যবহারকারীরা রয়েছে। নিজস্ব মালিকানায় রয়েছে ৯,২৭৯টি এবং মাত্র ১০৮৩টি দলিল রয়েছে সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ হিসেবে। রাজ্যভিত্তিক হিসেবে উত্তরপ্রদেশ (সুন্নি)-র হাতে রয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি। উত্তরপ্রদেশে ২ লক্ষ ১৭ হাজারটি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। যদিও মোট জমির পরিমাণ এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উত্তরপ্রদেশের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। বাংলায় মোট ৮০ হাজার ৪৮০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাঞ্জাব (৭৫,৯৬৫), তামিলনাড়ু (৬৬,০৯২) এবং কর্নাটক (৬২,৮৩০)।
এই ওয়াকফ সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডের আওতাভুক্ত হলেও, বলা বাহুল্য এর অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ থাকে সেই রাজ্য বা জেলার প্রসাশনিক ক্ষমতায় থাকা দলের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকার একটি তথ্য পেশ করে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন নথিভুক্ত ওয়াকফ সম্পত্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ কর জমা পড়ার কথা, তা পড়েনা কেন্দ্রের তহবিলে। তাই করব্যবস্হা স্বচ্ছ করতে এবং ওয়াকফ সম্পত্তিতে দুর্নীতি মুক্ত করতেই কেন্দ্র সরকারের এই সংশোধনী।
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের পর তিন যুগ সিপিএম শাসনে এবং বর্তমানে বিজেপির ঘোরতর বিরোধী তৃণমূল জমানাতেও ওয়াকফ সম্পত্তির ভবিষ্যৎ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষত বিরোধীদের মূল ভোটব্যাঙ্কই হল মুসলিম জনসংখ্যা। সে কারণেই উত্তরপ্রদেশ, বাংলার মতোই পাঞ্জাব (আম আদমি পার্টি), তামিলনাড়ু (ডিএমকে) ও কর্নাটক (কংগ্রেস) ওয়াকফ বিলের লাগাতার বিরোধিতা করে চলেছে। অন্যদিকে, বিজেপি এই আইন বলবৎ করে ওয়াকফ সম্পত্তিতে স্বচ্ছতা আনতে পরোক্ষে জমির উপর কবজা নিতে চাইছে। উত্তরপ্রদেশ দীর্ঘদিন শাসন করেছে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি এবং কংগ্রেস। ফলে তাদের আমলেই বহু সম্পত্তি ওয়াকফের বলে ঘোষিত হয়েছে। যেখানে এখনও কমবেশি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলির। ফলে বিজেপির এই বিল আইনে পরিণত হলে মুসলিম ও বিরোধী দলগুলির ভোটেও হাত পড়তে পারে।
অর্থাৎ, কেন্দ্রের শাসকদলের সঙ্গে বিরোধী জোট শক্তির বিরোধের মূল কারণই হল, ওয়াকফ সম্পত্তির উপর দখলিসত্ত্ব কোন রাজনৈতিক দলের হাতে থাকবে। কারণ ওয়াকফ যতই মুসলিম ধর্মকেন্দ্রিক হোক না কেন, তাতে স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ রাখতেই এই প্রতিবাদ এবং মতোবিরোধ।