
নিজস্ব সংবাদদাতা: জীবনের শুরু থেকেই শুধুই লড়াই। মাথার উপর ছাদ নেই, নেই দৈনন্দিন নিরাপত্তা, নেই পড়ার পরিবেশ। তবু হাল না ছেড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল টালিগঞ্জের সনিয়া ঘোষ এবং হেস্টিংসের প্রিয়াঙ্কা প্রামাণিক। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় জয়ী দুই কিশোরীর সাফল্য আজ নজির গড়ছে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখার সাহসে।
টালিগঞ্জ গর্ভমেন্ট স্কুলের ছাত্রী সনিয়া পেয়েছে ২১০, কালীধন ইনস্টিটিউশনের প্রিয়াঙ্কার প্রাপ্ত নম্বর ২১২। নম্বরের দিক থেকে হয়তো চমক নেই, কিন্তু গল্পটা যে শুধুই সংখ্যা নয়। গল্পটা—অসাধারণ মানসিক জোরের, ক্লান্তিহীন চেষ্টার, আর এক মাতৃসত্ত্বার নিঃস্বার্থ সহায়তার।
এই মাতৃসত্ত্বার নাম মিত্রবৃন্দা ঘোষ। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মিত্রাদেবীর সঙ্গে এই দুই ছাত্রীর আলাপ হয়েছিল করোনা-আগে, রাস্তার ফুটপাতে। দুই অনাহারী কিশোরীকে খাবার দিতে গিয়েই বুঝেছিলেন, ওরা শুধু আঁকতে জানে না, পড়তেও চায়। কিন্তু ছিল না সেদিন কোনও সুযোগ।
করোনার পরে সেই সুযোগ তৈরি করেন মিত্রাদেবী। পরীক্ষা দিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয় সনিয়া ও প্রিয়াঙ্কা। শুরু হয় নতুন লড়াই। মিত্রাদেবীর কথায়, “ফুটপাতে যারা থাকে, তাদের জীবনে বইয়ের পাতাগুলো শুধুই বিলাসিতা। আমি সেটা বদলাতে চেয়েছিলাম। ওরা দু’জনও ভীষণ সহযোগিতা করেছে।”
বর্তমানে মিত্রাদেবী একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন ৪০ জন মেয়ের শিক্ষাকেন্দ্র। সেখান থেকেই মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নেয় সনিয়া-প্রিয়াঙ্কা। তবে রাত হলেই ফিরতে হয় ফুটপাতে। এখনও তাঁদের মাথার উপর নেই কোনও ছাদ। ফলপ্রকাশের দিন, চোখ ভেজে দু’জনের। “ম্যাডাম না থাকলে তো পড়াটাই হত না,” ভেজা গলায় বলে উঠল প্রিয়াঙ্কা।
কিন্তু এবার? মাধ্যমিক পেরোলেই কি সব সমস্যার ইতি ? নয়। সামনে আরও বড় লড়াই—উচ্চশিক্ষার খরচ, নিরাপদ আশ্রয়, সামাজিক স্বীকৃতি। এই অনিশ্চয়তার মাঝেই মিত্রাদেবী আশ্বাস দেন, “ওরাও তো আমার মেয়ের মতো। এভাবে তো ওদের থামতে দিতে পারি না। নিশ্চয়ই কিছু একটা করব।”
সনিয়া-প্রিয়াঙ্কার এই জয় আসলে এক সামাজিক ব্যর্থতার মুখে দাঁড়িয়ে এক সাহসিক ইতিহাস। এভারেস্ট জয় না হলেও, লড়াইটাও যে কোনও পর্বত চূড়া জয়ের চেয়ে কম নয়।
চোখ রেখেছে সমাজ, এবার দায়িত্ব নেওয়ার পালা প্রশাসনেরও।