
নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা : উত্তর কলকাতায় খেলাৎ ঘোষের বাড়িতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো পঞ্চানন কর্মকারের বিভিন্ন কাজের এক প্রদশর্নীর। ১০ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রদর্শনী চলল। সম্পূর্ণ পারিবারিক আগ্রহ থেকেই এই প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান পঞ্চানন কর্মকারের বংশধর। বিবিধ হরফ লিপি এবং যে সব মেশিনের দ্বারা কাজগুলো হতো সেই সব কিছু নিয়েই এই ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী ইতিহাস প্রিয় দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছে।
পঞ্চানন কর্মকার, যিনি ছিলেন বাংলার এক নতুন যুগের সূচনাকার। যার হাত ধরে এসেছিল এ দেশের মুদ্রণ শিল্প। তিনি ছিলেন বাংলা মুদ্রণাক্ষরের স্রষ্টা ও মুদ্রণশিল্পের প্রযুক্তিবিদ। থাকতেন শ্রীরামপুরে। চার্লস উইলকিন্সকে প্রথম বাংলা মুদ্রণকাজে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত কাঠের তৈরি বাংলা বর্ণ এবং মুদ্রণাক্ষর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহজপাঠ ছাপার আগে পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলা ছাড়াও আরবি, ফার্সি, মারাঠি, তেলুগু, বর্মী ও চিনা সহ ১৪টি ভাষার মুদ্রণশিল্পের উন্নতি করেছিলেন। সেই কাহিনি আজও বাংলার এক গর্বের ইতিহাস।
১৮ শতকের শেষ দিকের কথা। কর্মকাররা তখন ক্যালিগ্রাফিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তামার প্লেট, অস্ত্র, ধাতব পাত্র ইত্যাদিতে নাম এবং অলঙ্করণ খোদাই করার জন্য পরিচিত ছিলেন। পঞ্চানন কর্মকারের পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের তরবারি, ঢাল এবং বর্মের নকশা খোদাই করেছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ তিনি মল্লিক উপাধি পান।
ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের একদম প্রারম্ভিক কালে ইংরেজরা স্থানীয় ভাষাগুলি জানা ও জানানোর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল। ইংরেজ প্রাচ্যবিদ এবং ভাষাতত্ত্ববিদ নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের মতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা ততদিনে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। কিন্তু জনসাধারণকে বাংলা ব্যাকরণ শেখানোর জন্য বইয়ের প্রয়োজন ছিল। হ্যালহেড বাংলা ব্যাকরণের উপর একটি বই লিখেছিলেন, কিন্তু বাংলায় তা মুদ্রিত করার উপায় ছিল না। ইংরেজ টাইপোগ্রাফার, প্রাচ্যবিদ এবং এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চার্লস উইলকিন্স প্রথমে ইংল্যান্ডে বাংলা টাইপফেস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু এই প্রচেষ্টাটি খুব ব্যয়বহুল হওয়ায় তা সফল হয়নি। এরপরই তিনি খোঁজ পান পঞ্চানন কর্মকারের। যোগাযোগ করেন।
পঞ্চানন কর্মকার তখন ধাতুতে বাংলা ক্যালিগ্রাফির শিল্পে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। চার্লস উইলকিন্সের উৎসাহে পরে তিনি মুদ্রণের জন্য বাংলা হরফ তৈরি করেন। যার ফলে অবশেষে হ্যালহেডের বই ” এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ” মুদ্রিত হয়। পরে তিনি শ্রীরামপুর থেকে বাইবেলের বাংলা অনুবাদ মুদ্রণেও উইলিয়াম কেরিকে সাহায্য করেছিলেন। সেসব এখন ইতিহাস। পঞ্চানন কর্মকারকে নিয়ে এই প্রদর্শনী যেন দর্শকদের নিয়ে গেল ১৮ শতকে বাংলার এক নবজাগরণের যুগে।