
গৌতম রায়
আধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ার সঙ্গে ভারতকে, ভারতবাসীকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধীর ভূমিকা এবং অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এক অদ্ভুত বিয়োগান্তক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রাজীব ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর মা, ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ড তাঁকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে বাধ্য করেছিল। শোনা যায়, ইন্দিরার হত্যাকাণ্ডের সেই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে পত্নী সোনিয়া নাকি রাজীবের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করা নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাজি ছিলেন না।
শ্রীমতি গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর রাজীব প্রধানমন্ত্রীর হোন এটা খুব মন থেকে চাননি ইন্দিরা মন্ত্রিসভার দু’নম্বর ব্যক্তিত্ব তথা সেই সময় দেশের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় যেহেতু তিনি দু’নম্বর এবং ইন্দিরা তাঁর প্রতি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নির্ভরশীল ছিলেন। সেই কারণে প্রণববাবুও ছিলেন ইন্দিরা হত্যার অব্যবহিত পরে প্রধানমন্ত্রী দাবিদার। যদিও তাঁর সেই দাবি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। কংগ্রেসের নেতৃত্ব আদৌ আমল দেয়নি প্রণববাবু দাবির বিষয়টিকে।
কিন্তু এই ঘটনা রাজীবের কান এড়িয়ে যায়নি। ফলে ‘৮৪ লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা আবেগে অসাধারণ সাফল্য তিনি এবং কংগ্রেস দল অর্জন করবার পর, রাজীব যখন মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন প্রণব বাবু কে আর মন্ত্রিসভায় রাখেননি। এই ঘটনার রেশ কিছুটা বাংলার রাজনীতিতে পড়েছিল, যদিও সেটা কেবলমাত্র কংগ্রেসি পরিন্ডলেই ঘটেছিল। প্রণববাবু পৃথক দল করেন। কিন্তু সেই দল সাংগঠনিকভাবে বা ভোট রাজনীতিতে আদৌ কোনও রকম দাগ কাটতে পারেনি।
আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি রাজীব গান্ধীর একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি মনে করেছিলেন, প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে আধুনিকতার যে পর্যায়ে বিশ্বের উন্নতিশীল দেশগুলি প্রবেশ করতে চলেছে, সেই জায়গায় যদি ভারতকে পৌঁছে দেওয়া না যায়, তাহলে ভারতের নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে কর্মসংস্থানের দুনিয়াকে খুলে দেওয়া সহজ হবে না। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি যে নতুন ভাবে, নতুন প্রেক্ষিতে বিস্তৃত হচ্ছে, রাজীব নিজে বা তাঁর সহকর্মীদের পরামর্শে সে বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ না ঘটালে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কাছে সরকারের বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী কাজগুলোকে পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়। তাই টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে রাজীব গান্ধী, শ্যাম পিত্রোদার পরামর্শে যে ধরনের প্রযুক্তিগত নবায়ণ ঘটিয়েছিলেন, তা সমসাময়িক কালে ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়।
আজ ভারত টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে ধরনের উন্নতি ঘটাতে সম্ভবপর হয়েছে, তার সূচনা পর্বটি কিন্তু রাজীব গান্ধী করেছিলেন। রাজীবের অতি বড় বিরোধীরাও তাঁর এই বিজ্ঞানমুখী, আধুনিক প্রযুক্তি কেন্দ্রিক পক্ষপাতিত্বের দিকটি কে অত্যন্ত সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে মূল্যায়ন করেন।
১৯৮০ সালের নির্বাচনে শ্রীমতি গান্ধীর প্রত্যাবর্তনের পেছনে পর্দার আড়াল থেকে আরএসএসের একটা ভূমিকা ছিল। আরএসএসের সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর সম্পর্কটা প্রকাশ্যে বৈরিতার থাকলেও পর্দার আড়ালে এক এক সময়ে এক এক রকম আকৃতি ধারণ করেছিল ।
সিন্ডিকেট লবিকে নাজেহাল করে শ্রীমতি গান্ধী যখন একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এবং দলের দায়িত্ব নিজের কব্জায় নিয়ে আসতে উন্মুখ, সেই সময়ে কংগ্রেসের ভেতরের সাম্প্রদায়িক, দক্ষিণপন্থী অংশ, যাঁদের উপর কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির একটা প্রভাব ছিল, তাঁদেরকে শ্রীমতি গান্ধীর প্রতি সমর্থন উজাড় করে দিতে আরএসএসের একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। অতুল্য ঘোষের মতো লোকেরা যেমন চেয়েছিলেন, শ্রীমতি গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করে পর্দার আড়াল থেকে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে। কারণ, পন্ডিত নেহরুর জীবদ্দশায় শ্রীমতি গান্ধী প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে থাকলেও প্রকাশ্যে খুব একটা কথাবার্তা বলতেন না বা তাঁর রাজনৈতিক কলা কৌশল ঘিরে কখনও কোনওরকম বিতর্কে জড়াতেন না।
তাই অতুল্য ঘোষদের মনে হয়েছিল, শ্রীমতি গান্ধীকে হাতের মুঠোয় রেখে পর্দার আড়াল থেকে দেশ পরিচালনার কাজটা তাঁদের পক্ষে করা খুব সহজ হবে। ঠিক সেভাবেই আরএসএসও ভেবেছিল, দলের মধ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে শ্রীমতি গান্ধীকে যদি আমরা সাহায্য করি, তাহলে শ্রীমতি গান্ধীর উপরে সঙ্ঘের একটা প্রভাব থাকবে। যেটি আখেরে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে ভোট রাজনীতিতে পরবর্তী সময়ে মাইলেজ দেবে।
অতুল্য ঘোষেরা যেমন শ্রীমতি গান্ধী সম্পর্কে ভুল মূল্যায়ন করেছিলেন, তেমনভাবেই সঙ্ঘও। শ্রীমতি গান্ধীর পরিণত, চতুর, প্রত্যুত্বপন্নমতিত্ব– সম্পর্কে কংগ্রেসের সিন্ডিকেট লবি, অতুল্য ঘোষ, কে কামরাজ, এস লিজলিঙ্গাপ্পা প্রমুখের যেমন কোনও বাস্তব ধারণা ছিল না। তেমনিই সঙ্ঘ নেতৃত্বেরও বাস্তব ধারণা ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী যখন যাকে দরকার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কখনো কারুর হাতের পুতুল হয়ে ওঠেননি। ব্যতিক্রম অবশ্যই কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয়।
ইন্দিরা গান্ধী শেষবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ধীরে ধীরে আরএসএস প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। মাত্র দু – আড়াই বছর মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রীসভায় নিজেদের লোক থাকার দৌলতে প্রশাসনের লোকেদের কব্জা করে এটা তারা করতে শুরু করে। বিষয়টি নিশ্চিত শ্রীমতি গান্ধীকে যথেষ্ট চিন্তান্বিত করে তুলেছিল।
তবে আরএসএসকে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলা করবার প্রশ্নে শ্রীমতি গান্ধী সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ পর্বে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। কারণ, তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অল্প কিছুদিন আগে, খোদ দিল্লি শহরের মধ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে গোটা সঙ্ঘ পরিবার ধর্ম সংসদ পরিচালনা করে। সেখনে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল। সে সম্পর্কে আমরা না, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ভাবে শ্রীমতি গান্ধীর কোনও দৃঢ় অবস্থান দেখতে পাইনি।
শ্রীমতি গান্ধীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর লোকসভার ভোটে কংগ্রেসের অভূতপূর্ব সাফল্যের পিছনে সেসময়ের প্রবীণ রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সকলেই শ্রীমতি গান্ধীর মৃত্যু জনিত সহানুভূতির বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন; জীবিত ইন্দিরা থেকে মৃত ইন্দিরা ভোটের রাজনীতিতে বেশি শক্তিশালী।
কিন্তু পরবর্তী সময়ের জাতীয় রাজনীতির নানা গতিপথ ধরে একটা ধারণা উঠে আসছে যে, শ্রীমতি গান্ধীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে কংগ্রেস দলের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে আরএসএসের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা কাজ করেছিল। আরএসএসের ধারণা ছিল, রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ক, অপরিণত রাজীব গান্ধীকে নানা ভাবে আরএসএসের লোকদের দিয়ে ঘিরে রেখে এমন ধরনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তারা রচনা করতে সক্ষম হবে, যার দ্বারা ভবিষ্যতে আরএসএসের হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রসারিত করা এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ভোট রাজনীতিতে অনেক বেশি সুযোগ করে দেওয়ার কাজটি সুবিধাজনক হবে।
এই লক্ষ্যেই আরএসএস, রাজীব গান্ধীর চারপাশে তাঁর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে এমন কিছু মানুষদের ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়, যারা একাধারে সামনাসামনি রাজীবের সঙ্গে সখ্যতার অভিনয় করলেও, প্রকৃতপক্ষে এমন ধরনের কর্মে রাজীবকে উৎসাহিত করেছে, যা আখেরে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির পালে হাওয়া যোগানোর মতো ব্যাপার ঘটেছে। প্রশাসনের মধ্যে এই সময়কালে আরএসএস, হিন্দু সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন একটা বড় অংশের লোকেদের শক্তিশালী করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল ।
তার পাশাপাশি রাজীব গান্ধীকে ঘিরে অরুন নেহেরু, অরুন সিং প্রমুখের মতো লোকেদের যে আনাগোনা এবং রাজীবের উপরে তাঁদের যে প্রভাব, তার পেছনে একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল এই দুই অরুণ। রাজীবের পুরোনো বন্ধু হলেও তাঁদের উপরে সঙ্ঘের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। রাজনৈতিকভাবে অপরিণত রাজীবকে দিয়ে এমন কিছু কাজ তাঁরা করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার জেরে আখেরে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির অসম্ভব লাভ হয়।
শাহবানু মামলা এবং তার পরবর্তী সময়ে রাজীব সরকার যেভাবে মুসলিম নারী অধিকার রক্ষা বিল এনে মুসলিম মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে একটা আপোসের পথ ধরে মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল অংশকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন, মৌলবাদীদের যেভাবে শক্তি যুগিয়ে ছিলেন, তা হিন্দু মৌলবাদকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সেইসময় একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
অপরপক্ষে দীর্ঘদিন তালা বন্ধ থাকা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে রাজীব গান্ধী যে ভয়ংকর রাজনৈতিক সামাজিক অপরাধটি করেছিলেন তার সুযোগ নিতে গোটা হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির এতটুকু সময় নষ্ট করেনি।
গোটা ভারত জুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির এই যে ভয়ংকর আস্ফালন, গোটা দেশের সাংবিধানের চরিত্রকে বদলে ফেলবার নোংরা ষড়যন্ত্র– এ সমস্ত কিছুর মূল কিন্তু লুকিয়ে আছে রাজীব গান্ধীর সরকারের বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যে। এই ঘটনা কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির মূল প্রতিভু আরএসএস এবং তার বিভিন্ন ধরনের শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যেতে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছিল ।
বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার ঘটনার পরম্পরা হিসেবেই ভিপি সিং-এর সরকারের আমলে আদবানীর রথযাত্রা, গোটা দেশ জুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। পরবর্তীকালে ইট পুজো, যাকে হিন্দুত্ববাদীরা শিলা পুজো, শিলান্যাস ইত্যাদি ইত্যাদিতে অভিহিত করে। এরই জেরে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো একটি সামাজিক অপরাধ সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কেউ কেউ মনে করেন, বফোর্স দুর্নীতি ইত্যাদি প্রশ্নে বামপন্থীরা যেভাবে কংগ্রেস দল এবং রাজীব গান্ধীর সমালোচনায় সেদিন মুখর হয়েছিল, তার পরিণতিতে বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের জায়গাটা একটু সুবিধে হয়েছিল। প্রকৃত ঘটনা হলো, রাজীব তাঁর মাতামহ পন্ডিত নেহরু বা মা ইন্দিরার বিদেশ নীতির জায়গা থেকে কিছুটা সরে আসবার একটা আভাস দিতে শুরু করেছিলেন। নেহরু বা ইন্দিরা ,বিদেশ নীতির প্রশ্নে যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাশে নিয়ে চলবার পক্ষপাতী ছিলেন, সেই জায়গা থেকে রাজীব সরে আসছেন। তাঁর বিদেশ নীতি যে অনেকটাই মার্কিনমুখী হয়ে যাচ্ছে –সেই ইঙ্গিত কিন্তু তার কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানকে কব্জা করে রেখেই ভারতের উপরে প্রভাব বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তার পাশাপাশি বাংলাদেশের সেই সময়ের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে বাংলাদেশের উপরেও নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমেরিকা অনেকাংশেই সাফল্য লাভ করেছিল। বাংলাদেশে আজ যে এনজিও রাজের ভয়ংকর দাপট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, আমেরিকা সেই সময়কাল থেকে ওই ধরনের সমান্তরাল অর্থনীতির প্রচলন বাংলাদেশে তথাকথিত সমাজসেবী সংস্থাগুলির মাধ্যমে করতে শুরু করেছিল। একইভাবে ভারতের নানা ধরনের এনজিওকে বড় রকমের ফান্ডিং করে একটা সমান্তরাল অর্থনীতি তৈরির প্রবণতাও আমেরিকার ছিল। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে নানা রকম অছিলায় বিদেশ থেকে মোটা অংকের টাকা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটা ভূমিকা কথা শোনা যেত তখন।
রাজীব তাঁর সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে অস্বীকার করে খানিকটা তাঁর মায়ের পথে হাঁটবার চেষ্টা করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে নানা অভিজ্ঞতা নিরিখে সেই জায়গাটাকে তিনি কিছুটা হলেও সংশোধনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তবে ক্ষমতা ও অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নে ইন্দিরার আমল থেকেই গোটা ভারত জুড়ে অকংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের যে দাবি, তার প্রতি উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে রাজীব আদৌ পরিণত রাজনৈতিক বোধের পরিচয় রাখেন নি।
তার পাশাপাশি খানিকটা ক্ষমতার মদমত্ততায় ১৯৮৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রচারকার্যে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুর অবসর চেয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে যে ধরনের রাজনৈতিক অষ্টাচারের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতির দুনিয়ায় যে ব্যক্তি অসূয়া, অশিষ্টাচারের বন্যা শুরু হয়েছে, তার শুরু আজ বলা যেতে পারে। রাজীবের সেদিনের সেই জ্যোতিবাবু সম্পর্কে মন্তব্য তাঁর দল কংগ্রেসকে তো কোনও রাজনৈতিক মাইলেজ দিতে পারেনি, বরঞ্চ বলা যেতে পারে ‘৮৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জ্যোতিবাবু নেতৃত্বে বামফ্রন্ট যে রেকর্ড করেছিল, সেই রেকর্ড বামফ্রন্ট আমলে আর হয়নি।