
কুশল চক্রবর্তী : বিজ্ঞাপন দিয়ে যদি কোনও বস্তুর মান বাড়ানো যেত তা হলে হয়তো ভারতীয় ক্রিকেট এমনভাবে পরপর দুটো সিরিজ ২০২৪-২৫ সালে পরাজিত হত না। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমিদের আকৃষ্ট করতে ক্রিকেটকে যারা পণ্য করে তুলেছে, তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। দু-দলের খেলার মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগাতে টেস্ট ক্রিকেটের মাঠে জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়েছিল। কিন্তু ভারতের দুটো আশাই সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজে মাঠে ফেলে আসতে হয়েছে। এক অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে আবার বর্ডার-গাভাসকর ট্রফির উপর দখল রাখা ও দুই তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে নিজদের তুলে নিয়ে যাওয়া। নিউজিল্যান্ডের কাছে নিজেদের মাঠে ‘ধবল ধোলাই’ হবার পর অনেক ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমিই এবার আশঙ্কায় ছিলেন ভারতীয় দলের অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার ফলাফল নিয়ে। হলও তাই। সিরিজের ভারত হারল ৩-১ ব্যবধানে। তবে একথা বলা যেতেই পারে যে, সত্যিকারের লালবলের ক্রিকেটপ্রেমিরা কিন্তু দু-দলের খেলাতেই হতাশ হলেন। টেস্ট ক্রিকেটের যে ধ্রুপদী স্বাদ, তার ছিটেফোঁটাও পাওয়া গেল না। সর্বত্র যেন টি-টুয়েন্টির গন্ধ।

ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু কথা তুলে আনা যাক। ১৯৬৮ সালে পতৌদির নেতৃত্ব ভারতীয় টেস্ট দল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৪-০ খেলায় হেরেছিল। সিডনিতে অনুষ্ঠিত শেষ টেস্টের পঞ্চম দিনে ভারতীয় দল তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫ রানে হারিয়েছিল চারটে উইকেট। যেমন এবারের সিডনি টেস্টের তৃতীয় দিনে ভারত তার দ্বিতীয় ইনিংসে হারিয়েছে তাদের ৪ উইকেট মাত্র ৯ রানে। সেবার কিন্তু তৎকালীন অসাধারণ খেলোয়াড় চান্দু বোরদে একেবারেই ভালো খেলতে পারেননি। আর তখন তো বলতে গেলে ভারতীয় দলে আজকের মতো কোচের প্রবেশই ঘটেনি। আর এবার কথা উঠছে অধিনায়ক রোহিত শর্মা আর ভারতীয় দলের অনন্য খেলোয়াড় বিরাট কোহলিকে নিয়ে।
৩৭ বছরের রোহিত এই সফরে ৫ ইনিংসে মিলিয়ে করেছে ৩১ রান। রানের গড় থেকেছে ৬.২। আর ৩৬ বছরের বিরাট কোহলি পাঁচ টেস্টে করেছে ১৯০ রান আর তাতে একটা সেঞ্চুরি থাকলেও যেভাবে বারবার আউট হয়েছে, তাতে তাঁর ক্রিকেট জীবনের উপর উঠে এসেছে প্রশ্নচিহ্ন। কিন্তু তাকিয়ে দেখুন ক্রিকেট থেকে এদের রোজগারের পরিমানটা। কোহলির সম্পদ প্রায় ১০৫০ কোটি টাকা, আর রোহিতের সম্পদ ২১৪ কোটি টাকা। শুধু তাই নয় আগামী দিনগুলোতে আছে তাঁদের আরও অনেক টাকা রোজগারের হাতছানি। তাই যাঁরা আশা করছেন এই দুজনের ক্রিকেট মাঠ থেকে বিদায়ের সময় এসে গিয়েছে, তাদের হয়তো দু-বার ভাবতে হবে। কারণ এদের জীবন দাঁড়িয়ে আছে ক্রিকেট ছাড়া আরও অনেক কিছুর উপর। আর শুধু এই দুজনের উপরে দোষ চাপালেই কী হবে, কী বোলিং করেছে জসপ্রীত বুমরা ছাড়া অন্য বোলাররা। এই সিরিজে যখন একাই বুমরা নিয়েছে ৩২টি উইকেট, অন্যদিকে বুমরার চেয়েও বেশী বল করে মাত্র ২০টি উইকেট নিয়েছে মহম্মদ সিরাজ আর তারপরেই আছেন মাত্র ৬টি উইকেট নেওয়া প্রসিধ কৃষ্ণ। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অধিনায়ক প্যাট কামিন্স যেমন ২৫টি উইকেট নিয়েছে, তেমনই স্কট বোলান্ড ২১টি আর মিচেল স্টার্কও ১৮টি উইকেট নিয়ে ভারতের হারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্রিকেট বিশ্বে বেশ কিছুদিন ধরেই চলেছে ‘কালো হাতের’ গল্প। যত বেশী টাকা ঢুকেছে ক্রিকেটে, তত উঠে এসেছে ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিংয়ের মতো সব ঘটনা। এবারও এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা এই সিরিজে দেখা গিয়েছে, তা না হলেই হয়তো ভালো হত।
বিরাট কোহলির মাঠের মধ্যে আচরণও যথেষ্টই সমালোচনার যোগ্য। তাঁর ম্যাচ-ফির ২০ শতাংশ কাটা বা একটি ডিমেরিট পয়েন্ট কাটাকে মাইকেল ভন, মার্ক ওয়া বা হারমিসনের মতো ক্রিকেটার কম শাস্তি বলেই মনে করেছেন। কিন্তু ক্রিকেটকে যাঁরা পণ্য হিসাবে তুলে ধরবার জন্য ব্যস্ত, তাঁরা কিন্তু মনে করেছেন যে কোনও বিতর্কই পণ্যটিকে আরও বেশী আকর্ষণীয় করে তোলে। আর আকর্ষণীয় বস্তুরই চাহিদা বাড়ে বেশি। আর তার থেকে বাড়ে মুনাফা। যে ভারতীয় বোর্ড বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থাকে সবচেয়ে বেশী টাকা দেয়, তারাই সেই সংস্থা আইসিসির রোজগারের ৩৮.৫ শতাংশ পায়। যেখানে কিনা ইংল্যান্ড পায় ৬.৮৯ শতাংশ আর আস্ত্রেলিয়া পায় ৬.২৫ শতাংশ। অথচ বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই খেলায় কারও তুলনাই চলে না। যে ভারত চিৎকার করছে তারা ২০১৪ সালের পর এবারই প্রথম বর্ডার গাভাসকার ট্রফি হারাল। তারা এক নাগাড়ে বিশ্বের সব টেস্ট খেলিয়ে দেশের রাবার রাখেছে একটানা মাত্র ৩২৫ দিন অন্য দিকে অস্ট্রেলিয়া সেটা রেখেছে ৬২৯ দিন। আর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র যখন আইসিসির কর্ণধার হিসেবে মঞ্চে আসীন হন, তখন তো তাঁর দায়িত্ব বাড়ে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য কিছু করে দেখাবার।
তখনও টি-টুয়েন্টির প্রবেশ বিশ্ব ক্রিকেটে ঘটেনি, প্রয়াত সাংবাদিক ও ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হেনরি ব্লফিল্ড বলেছিলেন, ‘৫০ ওভারের খেলা হছে প্রদর্শনী আর টেস্ট হচ্ছে পরীক্ষা।‘ টেস্ট ক্রিকেটটা পাঁচ দিন ধরে হলেও এখানেই পরীক্ষা হয় একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়ের সমস্তরকম স্কিলের। ব্যাটসম্যানের জন্য থাকে তাঁর ধৈর্য, টেকনিক আর সময়োপযোগী শট খেলার দক্ষতা। আর বোলারের জন্য থাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ফিল্ডিং অনুসারে বল করা। কিন্তু ক্রিকেটের এই ধ্রুপদী শিল্পের প্রতি ব্যবসায়ী মনোভাবের লোকেদের বড়ই অনীহা। তাকিয়ে দেখুন এই সিরিজেও কীভাবে পন্থ, হেড আউট হয়েছে? দলের কথা না ভেবে কীভাবে সিরাজ বা জাদেজা বল করেছে।

পরিশেষে একটা কথা বলা যায় যে, ভারতীয় দলের কোচ গৌতম গম্ভীর নিয়ে প্রশ্ন তুললে কি ‘দেশদ্রোহীতা’ বলে আঙ্গুল তোলা হতে পারে? তাঁর কোচিংয়ে বিগত ১০টি টেস্টের মধ্যে ভারত হেরেছে ৬টি টেস্টে, একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। আর যে তিনটি টেস্ট ভারত জিতেছে, তার মধ্যে দুটো টেস্ট হয়েছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে। গৌতম গভীরের প্রশিক্ষণে নিজেদের দেশে টেস্টে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৩-০ ফলে হার ছাড়াও আছে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তাদের কাছে একদিনের সিরিজে হার।
আর যাই হোক না কেন, নিন্দুকেরা যে গৌতম গম্ভীরের ভারতীয় দলের কোচ হিসেবে নিযুক্তিকে কিছুটা হলেও রাজনীতির চাল বলে অভিহিত করেছিল, ঘটনাগুলো কি তাদের হাতই শক্ত করল না?