
ওঙ্কার ডেস্ক: পৃথিবীর আলো প্রথমবার দেখেছিল মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। তারপর আবার ফিরে গিয়েছিল নিজের আশ্রয়ে—মায়ের গর্ভে। আর সেখান থেকেই হল এক অলৌকিক প্রত্যাবর্তন। ফের পৃথিবীর কোলে এল সে। দ্বিতীয়বার। এক নবজাতকের এই অবিশ্বাস্য জন্মগাথা এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাতায় ইতিহাস হয়ে উঠছে।
ঘটনাটি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড শহরের। সেখানে এক শিক্ষিকা লুসি আইজ্যাক ও তাঁর স্বামী অ্যাডাম আইজ্যাকের কোল আলো করে এসেছেন ছোট্ট ব্যাফার্টি আইজ্যাক। কিন্তু ব্যাফার্টির জন্ম কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। সে যেন জন্মেছে এক অলৌকিক চিকিৎসা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।
৩২ বছরের লুসি তখন মাত্র তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বাভাবিক নিয়মে একদিন আলট্রাসাউন্ড করাতে গিয়েই জানা গেল, তাঁর ডিম্বাশয়ে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ—ক্যান্সার। রিপোর্ট দেখে থমকে গেলেন জন ব়্যাডক্লিফ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।
অপেক্ষা করা মানেই বিপদ। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে পারে শরীরে। যত দ্রুত সম্ভব অস্ত্রোপচার দরকার।
কিন্তু তত দিনে গর্ভে বেড়ে উঠছে ছোট্ট প্রাণ। কিহোল সার্জারির কোনও সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে মা লুসিও জীবনের দামে হলেও সন্তানের ক্ষতি চান না। এই অবস্থাতেই এগিয়ে এলেন বিশিষ্ট সার্জেন ডা. সোলেমানি মজদ। এক অভূতপূর্ব, জটিল অস্ত্রোপচারের পরিকল্পনা করলেন তিনি—একটি অস্ত্রোপচার, যা পৃথিবীতে হাতে গোনা কয়েকবারই হয়েছে।
ডা. সোলেমানি জানালেন, জরায়ুটিকে সম্পূর্ণ শরীর থেকে বের করে ক্যান্সারের কোষ অপসারণ করে আবারও শরীরে প্রতিস্থাপন করা হবে। কিন্তু গর্ভে থাকা ভ্রূণকে রাখতেই হবে সুরক্ষিত। তাঁর সিদ্ধান্তেই ১৫ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের একটি বিশেষ দল গঠিত হল।
২০২৩-এর অক্টোবরে, অন্তঃসত্ত্বা লুসি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। শুরু হল পাঁচ ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচার। অপারেশনের সময় লুসির জরায়ুকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলেও তা রক্তনালির সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়, যাতে ভ্রূণের কোনও ক্ষতি না হয়। উষ্ণ স্যালাইনের প্যাকেটে মুড়ে রাখা হয় জরায়ু—প্রতিটি ২০ মিনিট অন্তর বদলানো হয় সেই প্যাকেট।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে জরায়ুসহ শরীরের বাইরে ছিল ভ্রূণ। চিকিৎসকরা বলেন, সেই কারণেই পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার জন্ম হয়েছে ব্যাফার্টির। অপারেশন সফল। ফের জরায়ু স্থাপন করা হল লুসির শরীরে।
তারপর কেটে গেল কয়েক মাস। অবশেষে জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে জন্ম নিল ব্যাফার্টি। মায়ের কোল জুড়ে এল এক নতুন সূর্য, জীবনের প্রতীক হয়ে।
এই শিশুটিকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সেই চিকিৎসকরাও। ডা. সোলেমানি বলেন, “আমি ওকে আগেও দেখেছিলাম—তখন সে শুধু এক ভ্রূণ। আজ সে এক প্রাণবন্ত, সুস্থ শিশু। এ এক অপূর্ব অনুভূতি।”
লুসি আর অ্যাডাম এর আগে অনেক কঠিন সময় পেরিয়েছেন। ২০২২ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছিল অ্যাডামের। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ফিরেছেন লুসি নিজেও। তাই ছেলেকে কোলে নেওয়ার মুহূর্তকে তাঁরা বলেন—“এক অলৌকিক উপহার”।
বর্তমানে ব্রিটেনে প্রতি বছর ৭০০০-এরও বেশি মহিলা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যাঁদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়ে দেরিতে। প্রতিবছর মৃত্যু হয় প্রায় ৪০০০ জনের। তাই চিকিৎসকেরা বলছেন—লুসির মতোই সচেতনতা ও সময়মতো চিহ্নিত করাই পারে প্রাণ বাঁচাতে।
আর সেই লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে আজ পৃথিবীর আলোয় এসেছে ব্যাফার্টি। দ্বিতীয়বার জন্ম নিয়ে একবার নয়, দু’-দু’বার পৃথিবীর মুখ দেখেছে সে। এই নবজাতকের জন্ম যেন জীবনযুদ্ধের জয়গাথাই বলে।
পুনর্জন্মের এই কাহিনি একটিই বার্তা দেয়—আশা থাকলে অসম্ভবও সম্ভব।