
শুভাশিস চট্টোপাধ্যায়ঃ নিভে গেল একটি মশাল। ২১ জুন সন্ধ্যায় ৬৩ বছরে চির ঘুমের দেশে পাড়ি জমালেন প্রবীন সাংবাদিক তথা সমাজকর্মী দেবাশিস আইচ, যদিও ওই নামে তাঁকে গুটি কয়েকই চিনতেন। বাচ্চু দা নামেই তিনি মিডিয়া জগতে বেশি পরিচিত। চিত্তরঞ্জন আইচ এবং অশোকা আইচের দ্বিতীয় সন্তান দেবাশিসের জন্ম উত্তর কলকাতায় ১৯৬১ সালের ২৭ জানুয়ারি। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক। ছাত্রাবস্থা থেকেই জড়িয়ে পড়েন নকশালপন্থী আন্দোলনে। নকশালপন্থী সংগঠন পিসিসিএল-এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরে মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএলের রাজ্য সম্পাদকও হন।
আমার সঙ্গে বাচ্চুদার আলাপ আকাশ বাংলায় কাজ করার সময়। তার আগে বিভিন্ন পথসভা, মিছিল এবং মৌলালিতে অধুনা শ্যামলদার চায়ের দোকানে বার কয়েক দেখা হলেও তেমন পরিচয় ছিল না। এখন বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্যামলের চায়ের দোকানে টেবিলে বসে প্রয়াত সাংবাদিক তথা নকশালপন্থী কর্মী বরেন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বাচ্চুদার তুমুল তর্কেরও সাক্ষ্মী থেকেছি। গত শতকের শেষের দিকে তখন প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই শ্যামলদার চায়ের দোকানে আড্ডা বসতো। সেখানে আড্ডা দিতেন প্রয়াত সাংবাদিক বরেনদা, প্রয়াত অধ্যাপক অরিজিত্ মিত্র, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতুদা, মধুময় পালের মতন সাংবাদিকরা।
২০o১ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাচ্চুদার সঙ্গে আকাশ বাংলায় কাজ করেছি। সত্যি বলতে গেলে কাজ শিখেছি। বাচ্চুদা আকাশ বাংলায় প্রথম থেকেই জেলার দ্বায়িত্বে। বাংলার জেলাগুলিকে হাতের তালুর মতোন চিনত। অসম্ভব ভাল পড়াশোনা । কিন্তু ঠিক সিড়ি ভাঙ্গার অঙ্কটা জানতো না। তাই ২৪ ঘন্টায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ডাক পায়নি তৎকালীন হেডের সুনজরে না থাকায়। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তারপর কলকাতা টিভিতে চলে যায় বাচ্চুদা। NE বাংলাতেও কাজ করেছেন দাপটের সঙ্গে। বসেদের কাছে প্রাপ্য সম্মান না পেয়ে অবশ্য বাচ্চুদার বিশেষ কিছুই যায় আসেনি। বাচ্চুদাকে যারা চিনতো জানতো তাদের মধ্যেও এব্যাপারে ব্যবহারগত কোনও পরিবর্তন দেখিনি। আমাদের অনেকের কাছেই সাংবাদিক তথা সমাজকর্মী দেবাশিস আইচ রয়ে গেছেন ফেস পাউডার লাগিয়ে স্টুডিওয় সেজে গুজে বসে উত্তম কুমারের মতন তুখোর সঞ্চালক হিসেবে নয়, বরং ঘামের গন্ধ নিয়ে মেঠো সাংবাদিক হিসেবেই। আমি যেটুকু কপি লিখতে শিখেছি তার পিছনে প্রয়াত সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য, চিন্ময় নাথ সহ আরও দু একজনের মতো বাচ্চুদারও অনেকটাই অবদান আছে। দেবাশিস ভট্টাচার্য চলে গেছেন বছর দেড়েক আগে এবার চলে গেলেন বাচ্চুদাও। মৃত্যুর পর নিজের চোখ দুটি বাচ্চুদা দিয়ে গেছে দৃষ্টিহীনদের জন্য।
জীবন সম্পর্কে অদ্ভূত রকমের নিরাসক্ত ছিল বাচ্চুদা। যতটুকু না হলে জীবন চলে না, ঠিক ততটা জোগাড় হয়ে গেলেই খুশি। কোনও চাহিদা নেই। বই আর একটু বেড়ানো হলেই খুশি। মা অন্ত প্রাণ। বছর খানেক আগে প্রেস ক্লাবে আড্ডায় বলল চাকরি তো কবে ছেড়ে দিয়েছি , এখন মায়ের পেনশনই ভরসা। জানিস আমি এখন বরিষ্ঠ নাগরিক।
২০১২ সালে পেয়েছেন জেলার সাংবাদিকতার জন্য “The Statesman Awards” for Rural Reporting
সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিলেও লেখালেখির জাগত থেকে বিদায় নেয়নি কখনো। বাচ্চুদার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই ভাত দে হারামজাদা, দুঃসময়ের আখ্যান, দহননামা, নিমকাঠির জীবন, আমাকে জাগিয়ে রাখো (কাব্যগ্রন্থ), রাত্রিকাল রাত্রিকথা (কাব্যগ্রন্থ), মায়াবন্দরের রূপকথা সহ বেশ কিছু অনুবাদ গ্রন্থ। এরমধ্যে দ্য কাফে টেবল প্রকাশিত ‘ভাত দে হারামজাদা’ বইটি করোনা, লকডাউন, পরিযায়ী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদের মশাল। এই বইটির জন্য ২০২২ সালে পান ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের অধ্যাপক প্রদীপকুমার বসু স্মৃতি সম্মান।
এছাড়াও বন্ধু সুমন সেনগুপ্তদের সহমন বলে একটা পত্রিকা সহ অসংখ্য ছোট বড় পত্রিকায় লিখেছেন অসুস্থ হবার আগে পর্যন্ত। আমার সঙ্গে শেষ দেখা এ বছরের বই মেলার শেষ দিনে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নে। ওই শেষ আড্ডা।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ যখন সুমিত দা ( চৌধুরী) বলল বাচ্চু দা মারা গেছে, প্রথমে বিশ্বাস হয়নি । বাচ্চুদার ভাই আমার প্রাক্তন সহকর্মী অভিষেককে ফোন করি। ও জানায় খবরটা সত্যি। বাচ্চুদার প্রয়াণে শোক জানিয়েছে কলকাতা প্রেস ক্লাব। কাল রাত থেকেই সোস্যাল মিডিয়ায় উপচে পড়েছে পোস্ট। বাচ্চুদা কখনই কেউকেটা সাংবাদিক বা মালিকের পছন্দের সাংবাদিক হতে চায়নি, বাচ্চুদা চেয়েছিল জনগণের সাংবাদিক হতে, অল্টারনেটিভ মিডিয়া পার্সন হয়ে উঠতে। সেই লক্ষ্যে ১০০ শতাংশ সফল বাচ্চুদা।
শুক্রবার রাত পৌণে ১০ টা নাগাদ যখন জনা কুড়ি বাচ্চুদার বন্ধু, শুভাকাঙ্খিরা তাঁকে শেষ বিদায় জানাচ্ছি লাল পতাকায় মুড়ে তখনও মনে হচ্ছিল শেষ মুহূর্তে বোধ হয় অঘটন ঘটবে, বাচ্চু দা ঠিক উঠে বসবে। লম্বা লোকটি আবার হাঁটতে শুরু করবে। অনেকটা দূর থেকে ঠিক তাঁকে দেখা যাবে একটা মশালের মতন।