
ওয়েব ডেস্ক: সাংবাদিকতা বরাবর শাসকের কাছে বিপজ্জনক। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দায়ে সাংবাদিক, সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কারাপ্রাচীরের অন্তরালে নির্বাসিত করেছে। পরাধীন ভারতে সহিংস ও অহিংস পথে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবী নাগাড়ে ঘোরে, জীবনও তেমন চলমান। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে কিছু মানুষ বরাবর প্রতিবাদ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে শরিক হতে এককালে কালিকলম, একালে কম্পিউটার-ক্যামেরা-মোবাইল নিয়ে ময়দানে সামিল সাংবাদিকরা।
কলমকে স্তব্ধ, কম্পিউটার-সহ পেশাগত জরুরি কাজের সমস্ত যন্ত্র লাগাতারভাবে বাজেয়াপ্ত করছে রাষ্ট্র। আইনকানুন জারি করে সাংবাদিকদের কারাগারে পুরে দিতে রাষ্ট্র কোনও কার্পণ্য করছে না। পৃথিবীর যে দেশগুলোতে চলছে এই অপকাণ্ড, সেই তালিকায় ভারত অন্যতম, প্রথম সারির এক দেশ। কর্তৃত্ববাদী এনডিএ সরকার ভারতের মাটিতে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতায় লাগাতারভাবে হস্তক্ষেপ করছে. যা কার্যত জুলুমবাজির চেহারা নিয়েছে।
চীন, মায়ানমার, বেলারুশের মতো দেশে রাষ্ট্র সাংবাদিকদের ওপর লাগাতার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। চীনের নাগরিক সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংবাদিক এখন কারাপ্রাচীরের অন্তরালে। ‘কমিটি ফর প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট’ নামে এক সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, এমুহূর্তে চীনে ৪৪ জন সাংবাদিক কারাগারে রয়েছেন। তবে কারাপ্রাচীরের ওপারে নির্বাসিত সাংবাদিকের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হতে পারে। এবিষয়ে চীনদেশে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ চালু থাকায় সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যাচ্ছে না।
চীনের পর যে দেশ বেশি সংখ্যক সাংবাদিককে কারাগারে পুরে রেখেছে সেটা হল ভারতের আরেক প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার। আর সাংবাদিক নির্যাতনে বেলারুশ তৃতীয় স্থানাধিকারী দেশ। এমুহূর্তে বেলারুশে ২৮ জন সাংবাদিক কারাগারে বন্দি রয়েছেন। ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ সূত্রে জানা গিয়েছে, যেভাবে বিশ্বের নানা দেশে সাংবাদিক নিপীড়ন বেড়ে চলেছে, তাতে শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জীবন ও জীবিকাই বিপন্ন নয়, বরং চক্রান্ত করে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। যদিও এভাবে কলম, ক্যামেরা দমিয়ে রাখা যায় না, সাংবাদিকতার ইতিহাসে বিশ্বজুড়ে এটা বারবার প্রমাণিত সত্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সব বাধাবিপত্তিকে পেরিয়ে।
‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ গত শতকের ৯০-এর দশকের গোড়া থেকে কারাগারে পোরা সাংবাদিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। এরপর থেকে সংস্থার উদ্যোগে লাগাতার এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলেছে। দেখা যাচ্ছে, এমুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ৩২০ জন সাংবাদিককে কারাগারে পচিয়ে মারা হচ্ছে। খবরাখবর পরিবেশনের দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
এবার দেখা যাক ভারতের পরিস্থিতি। ২০১০ সালে ইউপিএ জমানার শেষাশেষি সময় থেকে সাংবাদিক নির্যাতনের বাড়বাড়ন্ত চলছে ভারতের মাটিতে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে সাংবাদিক নির্যাতন।
ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কারাগারে পোরা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে ইউএপিএ আইনে। আদতে সাংবাদিকদের রাষ্ট্রদ্রোহী সাজানো হচ্ছে। নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে তিহার জেলে বন্দি রাখার ঘটনা। চীনের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নিউজক্লিক ভারত-বিরোধী খবরাখবর প্রচার করছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে এহেন অভিযোগে প্রবীর পুরকায়স্থকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারের পর ভারতজুড়ে সাংবাদিকরা অবশ্য প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চের নির্দেশে সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ তিহার জেল থেকে কেবল মুক্তিই পাননি, বরং তাঁর গ্রেফতারি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট সাফ জানিয়েছে, প্রবীর পুরকায়স্থকে বেআইনিভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এখনও ভারতের কারাগারে ন্যায়বিচারের আশায় দিন গুজরান করছেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক। ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সাংবাদিকদের মুক্তিতে কিছু ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে, যা সাংবাদিকদের কাছে ইতিবাচক এবং ভরসা জাগানোর মতোই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েকমাস আগে কারাপ্রাচীরের অন্তরাল থেকে মুক্তি মিলেছে ‘কাশ্মীর ন্যারেটরে’র সাংবাদিক আসিফ সুলতানের। ২০১৮ সালে সাংবাদিক আসিফ সুলতানকে গ্রেফতার করার পরে তাঁর বিরুদ্ধে রীতিমাফিক রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করা হয়। এরপর টানা সাড়ে পাঁচ বছর তিনি বন্দিজীবন যাপন করতে বাধ্য হলেন।
সারা দুনিয়াজুড়ে বিপন্ন সেইসব সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম যাঁরা সত্য খবর প্রচারে দায়বদ্ধ। সাংবাদিকদের পেশার স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই চালাচ্ছে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, স্রেফ পেশাগত দায়বদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের চক্ষুশূল হওয়ায় এদেশের নাগরিক তিন শতাধিক সাংবাদিক ভারতের বিভিন্ন কারাগারে পচে মরছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে ১৯৯২ সালের পরে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে।
দুনিয়াজুড়ে এই বাস্তব সত্য ধারাবাহিকভাবে প্রমাণ করে চলেছে অন্যায়, হিংসা, বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, নারী নিপীড়ন, খিদে, অপুষ্টির মতো জীবনসমস্যার কারণ খুঁজে বের করার কাজে লিপ্ত প্রতিবাদী সাংবাদিকরা।