
সুমন গঙ্গোপাধ্যায় : দিল্লির সফর আর তাতেই বাজিমাত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের । আর সেই চালে অনেক টা ই ব্যাকফুটে কংগ্রেস। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে রাজ্যের বকেয়া নিয়ে বৈঠক, অপরদিকে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক। আর এখানেই ছক্কা মারলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দৃশ্য ১- ইন্ডিয়া জোটের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক, আর সেখানেই সবাইকে চমকে দিয়ে এই জোটের প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করলেন মল্লিকারজুন খারগের নাম। এই নাম প্রস্তাবের কারণ হিসাবে ব্যখ্যা দিলেন, বর্তমানে দেশে দলিতদের অবস্থা খারাপ, আর দলিত প্রতিনিধি হিসাবে খারগেই এই মুহূর্তে একমাত্র যোগ্য। মনে রাখতে হবে খারগের নাম প্রস্তাবের এই বৈঠকে তখন উপস্থিত খোদ সোনিয়া গান্ধী- রাহুল গান্ধী। অর্থাৎ খুব স্পষ্ট, গান্ধী পরিবারের বাইরে কাউকে যে এই জোটের মুখ করে কংগ্রেসের ভোটে লড়া উচিত তা বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
অথচ এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ইন্ডিয়া জোটের দ্বিতীয় বৈঠকে ‘রাহুল আমার ফেভারিট ‘ বলে মতামত দেন , আর সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই কিনা রাহুলকে বাদ দিয়ে বর্তমান কংগ্রেস সভাপতির নাম প্রস্তাব করলেন!আর তাতেই অবস্থা এমন জায়গায় দাঁড়ালো, সোনিয়া- রাহুলের সামনে অস্বস্তি এড়াতে ময়দানে নামতে হলো খোদ খারগেকে l জানিয়ে দিতে হলো আগে জোট ভোটে জিতেছে
দৃশ্য ২- সাংসদ এর বাইরে বিক্ষোভরত সাংসদদের মধ্যে থেকে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপ- রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধানকরকে নিয়ে অঙ্গভঙ্গি করলেন আর সেই ছবি মোবাইল বন্দী করলেন রাহুল গান্ধী। যা রীতিমত ভাইরাল হলো, নিন্দার ঝড় উঠল দেশ জুড়ে। এই ঘটনা নিয়ে কল্যাণ ban বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশানা করলেন রাহুল গান্ধীকে। তিনি জানিয়ে দিলেন রাহুল গান্ধী যদি এই ভিডিওটি না তুলত তাহলে কেউ এই ঘটনার কথা জানতে পারত না। এক্ষেত্রেও পরিস্থিতি এমন হলো বিবৃতি দিতে হলো রাহুল গান্ধীকে, ওয়াডানারের সংসদ জানালেন সেই ভিডিও তার মোবাইলেই আছে কাউকে শেয়ার করেননি।
দৃশ্য-৩। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফর্মুলা দিলেন গোটা দেশে ৩০০ আসনে লড়াই করুক কংগ্রেস, বাকি ২৪৫ , আসনে শরিকরা।
দৃশ্য-৪ । মোদীর বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী হোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই কংগ্রেস এর কোর্টেই বল ঠেলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।? এমনকি কংগ্রেস আরো ভালো করে বলতে গেলে রাহুল গান্ধীকেই টার্গেট করলেন তিনি।
কিন্তু কেন? আর ঠিক এখানেই রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি যে এই মুহূর্তে দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঘোল খাওয়াতে পারেন তা বুঝিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।যা হয়তো এখন টের পাচ্ছে কংগ্রেস। রাজনৈতিক মহলের মতে, পুরোটাতেই রীতিমত নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।এবার একটু বিশ্লেষনে আসা যাক। মনে রাখতে হবে, গান্ধী পরিবারের রাজীব- সোনিয়া র সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও রাহুল গান্ধীর সাথে খুব একটা সু- সম্পর্ক নেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর। রাহুলকে ‘পরিযায়ী পাখি’ একসময় কটাক্ষ করেছিলেন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। এমনকী মাঝে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে অ- বিজেপি জোট তৈরি করতে চেয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো।যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠেনি। তবে জোট হলেও শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বাকী শরিকদের বরাবরের অভিযোগ হাত শিবিরের ‘দাদাগিরি’, আর তার ফল ভুগতে হয়েছে কংগ্রেসকে। বিশেষ করে তিন রাজ্যের নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোটে থাকা সমাজবাদী পার্টি বা বামেদের সঙ্গে সমঝোতা না করে এককভাবে লড়েছিল কংগ্রেস। যার ফল ভুগতে হয়েছে ছত্রিশগড় রাজস্থান মধ্যপ্রদেশে পরাজিত হয়েছে কংগ্রেস। এই তিন রাজ্যে নির্বাচনের পর অনেকটাই চাপে শতাব্দী প্রাচীন এই দলটি আর তার ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টিপস কার্যত চরম অসস্তিতে ফেলে দিয়েছে রাহুল- সোনিয়াকে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিৎ দাসের মতে,” সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেই কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়িয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই ভারত জোড়া যাত্রার পর রাহুল গান্ধী আগামী দিনে কংগ্রেসের মুখ হিসেবে উঠে আসছিল কিন্তু ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে ভেবেচিন্তেই রাহুল সোনিয়াকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের দায়িত্বে থাকা মল্লিকারজুন খারগেকে মুখ হিসাবে তুলে আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর কয়েকটি দিক আছে, এক,কংগ্রেসকে পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার বার্তা, পাশাপাশি দলে, জোটে রাহুলের নেতৃত্বর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়া। অন্য আরেকটি দিক রাহুল- সোনিয়াকে বাদ দিয়ে বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি কোন সময় প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে রাজি হবেন না সে ক্ষেত্রে বেছে নিতে দ্বিতীয় কোনো অপশন। খুব স্বাভাবিকভাবে সে দিক দিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ফিটেস্ট নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে। অর্থাৎ রাহুল গান্ধীকে গুরুত্ব দিয়েও বুঝিয়ে দিলেন আসলে জাতীয় রাজনীতিতে রাহুল গান্ধী এখনও মুখ হতে পারেন নি। ” এর পাশাপাশি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পাশে দাঁড়িয়ে রাহুলকে টার্গেট করার পিছনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পাকা মাথা’ র কাজ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। খুব স্পষ্ট করে বলতে গেলে সংসদ এর বাইরে দেশের উপ- রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বিকৃত অঙ্গ ভঙ্গি করা গনতন্ত্রর পক্ষে কতটা স্বাস্থ্যকর তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তবে ওই দিন রাহুল গান্ধী র ভূমিকা নিয়ে ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় রাজনীতিতে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর থেকে ওজনে অনেক- অনেক এগিয়ে রাহুল গান্ধী। অথচ সেদিন তৃণমূল সাংসদের এ হেন ‘ অসংবিধা নিক ‘ কাজ কে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন সোনিয়া পুত্র। বিশ্বজিৎ দাসের ব্যাখ্যা, ” গোটা ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত রাহুলের গান্ধী কে ই কাঠগরায় তুলে আরো একটি ছক্কা হাকালেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তাঁর ওই বক্তব্য বুঝিয়ে দিল একজন দায়িত্ববান সাংসদ বা একটি জাতীয় দলের অন্যতম আইকন হিসাবে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর ভিডিও মোবাইলবন্দি করলো খুব অপরিনত রাজনীতির পরিচয় দিয়েছেন। আর সেটাই মিডিয়ার সামনে তুলে এই ইস্যুতেও রাহুলকে কিছু টা হলেও জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বহীন করে দিলেন।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় রাজনীতিতে মমতা- সোনিয়ার কেমিস্ট্রি খুব ভাল হলেও,রাহুল বরাবরই মমতা ‘বিরোধী’ বলে পরিচিত। সেদিক থেকে রাহুলকে ‘টার্গেট-পয়েন্ট’ বানিয়ে ওয়েট লেস করে দিলেন তিনি। বিশ্বজিৎ দাসের ব্যখ্যা, ” এর পিছনে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণ আছে, মুখ্যমন্ত্রীর গুডবুকে কোনো দিনই ছিলেন না রাহুল, সেক্ষেত্রে তার হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যাটিং করবেন এটা আশা করা আদপে বোকামি।”আর অনেকটা সেই ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারার কাজ টি করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এখানেই কি শেষ? খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে একদিকে ৩১ ডিসেম্বর এর মধ্যে ইন্ডিয়া জোটের আসন সমঝোতা নিয়ে কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়াতে বাকী শরিকদের রাজি করানোর পাশাপাশি, তিন রাজ্যের ভোটের ভরাডুবি নিয়ে আরজেডি, ডিএমকে, জেএমএমের মতো ‘সাইলেনট’ পার্টনারদের মুখ খোলার মতো পরিস্থিতি ও তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। এর পাশাপাশি গোটা দেশে ৩০০আসনে আর বাকী ২৪৫ আসনে শরিকদের প্রার্থী দেওয়ার ফর্মুলা ও বড় রাজনৈতিক প্ল্যানসহজ হিসাব, গোটা ৩০০ আসনে লড়াই করতে যদি কংগ্রেস রাজি
না হলে সেক্ষেত্রে যদি ‘জোটহীন’ লড়াই হয় সেক্ষেত্রে তার দায় ভার নিতে হবে কংগ্রেসকে, অপরদিকে ৩০০ আসনে লড়াই করে যদি প্রয়োজনীয় আসন কংগ্রেস না পায়,
অপরদিকে ২৪৫ আসলে লড়াই করে জোট শরিক আঞ্চলিক দল গুলো যদি বেশি সংখ্যক আসন পায়, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ‘ বার্গেনিং’এর জায়গায় আসতেই হবে কংগ্রেসকে। আর নিয়ন্ত্রণ থাকবে আঞ্চলিক দল গুলোর হাতে। এমনকী রাজ্যেও কংগ্রেসের জন্যে আসন সমঝোতার রাস্তা খোলা রেখেছেন খোদ নেত্রী l আর এখানে ও যদি প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব তৃণমূলের সাথে জোটে রাজী না হয়, আর সেক্ষেত্রে যদি বিজেপি বাড়তি সুবিধা পায়, তার দায়ও বর্তাবে সেই কংগ্রেসের উপরই। সব মিলিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে উভয় সংকটে কংগ্রেস। অনেকটা সেই ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা।