
স্পোর্টস ডেস্ক :অবশেষে জয়ে ফিরল ভারত। গত ১৬ মাস জয়ের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়া ভারতীয় দল বুধবার শিলংয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে মলদ্বীপকে ৩-০-য় হারিয়ে এই জয়ের খরা কাটাল সুনীল ছেত্রীর ভারত। স্প্যানিশ কোচ মানোলো মার্কেজ ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার এই প্রথম জয়ের মুখ দেখল তাঁর বাহিনী। আন্তর্জাতিক অবসর ভেঙে ফিরে আসা সুনীল ছেত্রী একটি গোল করে স্মরণীয় করে রাখলেন ভারতীয় দলে তাঁর ‘দ্বিতীয় অভিষেক’।
এ দিন দাপুটে ফুটবল খেলে ফিফা ক্রমতালিকায় ১৬২ নম্বরে থাকা মলদ্বীপকে হারায় ভারত। তিনটি গোলই আসে হেড থেকে। দু’টি আসে কর্নার থেকে। প্রথমটি দেন রাহুল ভেকে এবং পরেরটি আসে লিস্টন কোলাসোর মাথা থেকে, যা ভারতের জার্সি গায়ে তাঁর প্রথম গোল। শেষ গোলটির ক্ষেত্রে সুনীলকে অ্যাসিস্ট করেন তিনি। ওপেন প্লে থেকে পাওয়া এই গোলে সুনীল ফের একবার নিজের জাত চিনিয়ে দেন।
আগামী মঙ্গলবার এই মাঠেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে নামছে ভারত। তার আগে এই দাপুটে জয় ভারতকে যে অনেকটা আত্মবিশ্বাস এনে দেবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ম্যাচের পর কোচ মানোলো মার্কেজ সম্প্রচারকারী সংস্থাকে বলেন, “দলের পারফরম্যান্সে আমি খুশি। তবে এখনও কিছু কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে আমাদের। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচ আরও কঠিন হবে”। এ দিন ভারত যেখানে আটটি শট লক্ষ্যে রাখে, সেখানে প্রতিপক্ষকে একটির বেশি শট গোলে রাখতে দেয়নি তারা।
আগের দিন মার্কেজ বলেছিলেন, সুনীল ছেত্রী কিছুক্ষণের জন্য এই ম্যাচে খেলবেন। তবে এ দিন ম্যাচের ৮১ মিনিট পর্যন্ত মাঠে ছিলেন তিনি। প্রথমার্ধে তাঁকে খুব একটা উজ্জ্বল না লাগলেও দ্বিতীয়ার্ধে চেনা মেজাজে পাওয়া যায় তাঁকে। গোলে ছিলেন বিশাল কয়েথ। প্রথম এগারোয় ছিলেন শুভাশিস বোস, লিস্টন কোলাসো, নাওরেম মহেশ সিং। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামেন আপুইয়া, ফারুখ চৌধুরি, ইরফান ইয়াডওয়াডরা। ভারতের জার্সি গায়ে এ দিনই প্রথম মাঠে নামেন দুই তরুণ ডিফেন্ডার বরিস সিং ও অভিষেক সিং।
ম্যাচের শুরু থেকেই এ দিন আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিল ভারতীয় দল। ঘন ঘন আক্রমণে ওঠে তারা। বাঁ দিকের উইং দিয়ে লিস্টন কোলাসো ও ডানদিক দিয়ে ভালপুইয়া আক্রমণ তৈরি করার চেষ্টা শুরু করেন। মাঝখানে ছিলেন সুনীল ছেত্রী। বেশ কয়েকটি সুযোগ তৈরি করেও প্রতিপক্ষের গোলের সামনে খেই হারিয়ে ফেলে তারা। মলদ্বীপের রক্ষণও ছিল সদাসচেতন। ভারতের বেশ কয়েকটি আক্রমণ প্রতিহত করে তারা।
প্রথমার্ধের মাঝামাঝি, ২৩ মিনিটের মাথায়, বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয় পোস্টের সামনে একটি মাপা ক্রস পাঠান কোলাসো, যা নাওরেম মহেশের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এর দু’মিনিট পরেই প্রতিপক্ষের বক্সের বাইরে পছন্দের জায়গা থেকে নেওয়া ফ্রি কিকে সোজা গোলে বল রাখার চেষ্টা করেন কোলাসো। কিন্তু তা অল্পের জন্য বাইরে চলে যায়। ২৭ মিনিটের মাথায় সুনীলের উদ্দেশ্যে একটি বল বাড়ান সুরেশ, কিন্তু তার নাগাল পাওয়ার আগেই ক্লিয়ার হয়ে যায়। এর পরেও কোলাসো, শুভাশিসের মিলিত উদ্যোগে ফের বল আসে সুনীলের কাছে। কিন্তু এ বারও সেই বল ইন্টারসেপ্ট করেন মলদ্বীপের ডিফেন্ডার ও অধিনায়ক সামু আলি।
ওপেন প্লে থেকে গোল না পেয়ে দিশাহারা ভারত একাধিকবার সেটপিস থেকে গোল পাওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। কিন্তু ৩৫ মিনিটের মাথায় যে কর্নার পায় তারা, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোল পায় তারা। ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজ একেবারে মাপা কর্নার কিক রাখেন পেনাল্টি বক্সের মাঝখানে। যেখানে অনেকটা লাফিয়ে উঠে হেড করে জালে বল জড়িয়ে দেন রাহুল ভেকে (১-০)। এর আগেও ভারতের জার্সি গায়ে দু’টি গোল করেছেন রাহুল এবং দু’টিই হেডে।
কিন্তু এর পরেই চোট পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ব্র্যান্ডন, যার জেরে মাঠও ছাড়তে হয় তাঁকে। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে নামেন ফারুখ চৌধুরি। তিনি মাঠে নামার চার মিনিটের মধ্যেই দুর্দান্ত এক গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন। বাঁ দিক থেকে কোলাসো প্রথমে গোল এরিয়ায় বল ঠেলেন। তার পরে সুনীল, সুরেশ, ভালপুইয়ার পা হয়ে বল যখন বক্সের মাঝখানে আসে, তখন ফারুখ হেডে গোলের চেষ্টা করলেও সেই হেড তেমন জোরালো ছিল না। তিন মিনিটের সংযুক্ত সময়ে বাঁ দিক থেকে কোলাসো দ্বিতীয় পোস্টে ফের একটি মাপা ক্রস পাঠালেও সেখানে তাঁর কোনও সতীর্থ ছিলেন না। প্রথমার্ধে ভারত যেখানে দুটি শট গোলে রাখে, সেখানে মলদ্বীপের একটিও শট লক্ষ্যে ছিল না।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেও প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার চেষ্টা করে ভারত। দু’মিনিটের মাথায় সুনীলের হেড গোললাইনে সেভ করেন হামজা মহম্মদ। চার মিনিটের মাথাতেই ডানদিক থেকে ফারুখ প্রায় ফাঁকায় বল পেয়ে বক্সে ঢুকেও শেষ পর্যন্ত ডিফেন্ডারদের বাধায় বক্সের মাঝখানে থাকা সুনীলকে গোলের বল বাড়ানোর আগেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান। পরের মিনিটেই ফের একই জায়গা দিয়ে বক্সে ঢুকে নিজেই গোলে শট নেন ফারুখ। কিন্তু তাঁর শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
৫৭ মিনিটের মাথায় সুনীলের সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়া করে ফের বক্সে ঢুকেও গোলে শট নিতে ব্যর্থ হন ফারুখ। ৬২ মিনিটের মাথায় সুরেশ ও ভালপুইয়ার জায়গায় নামেন যথাক্রমে আপুইয়া ও বরিস সিং। এ দিনই প্রথম ভারতের হয়ে মাঠে নামেন বরিস। তাঁরা মাঠে নামার পর ফের বক্সের মধ্যে গোলের সুযোগ পান ফারুখ। কিন্তু ফের ব্যর্থ হন তিনি। ৬৫ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢুকে এ বার বাঁ দিকে কোলাসোর উদ্দেশ্যে ক্রস বাড়ান ফারুখ। সোজা গোলে শট নেন কোলাসো। কিন্তু পা দিয়ে বল আটকান মলদ্বীপের গোলকিপার হুসেন শরিফ। যার ফলে কর্নার পায় ভারত এবং সেই কর্নার থেকেই ব্যবধান বাড়ায় ভারত।
নাওরেম মহেশের দুর্দান্ত, মাপা কর্নার হাওয়ায় গতিপথ বদলে বক্সের মাঝখানে কোলাসোর মাথার ওপরে উড়ে যায়। নিখুঁত হেডে বারের নীচ দিয়ে জালে বল জড়িয়ে দেন সম্পুর্ণ অরক্ষিত কোলাসো (২-০)। এই গোলের মিনিট ছয়েক পরে ফের গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন, যখন বাঁ দিক থেকে মহেশের জন্য বল বাড়ান কোলাসো। কিন্তু তাঁর পাসে একটু বেশিই গতি থাকায় বলের নাগাল পাননি মহেশ।
মলদ্বীপ ম্যাচের প্রথম ভাল সুযোগটি পান ৭৩ মিনিটে, যখন ডানদিক থেকে মিডফিল্ডার ইব্রাহিম লো ক্রস পাঠান গোলের সামনে, ছগজের বক্সের মধ্যে। কিন্তু বরিস তাঁকে দেওয়ায় পরিবর্ত ফরোয়ার্ড হাসান নাজিম ঠিকমতো বলে পা লাগাতে পারেননি। অনায়াসে বলের দখল নেন গোলকিপার বিশাল কয়েথ।
তাদের এই গোলের চেষ্টার তিন মিনিট পরেই, ৭৬ মিনিটের মাথায় সেই মুহূর্ত আসে, যে মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন শিলংয়ের ফুটবলপ্রেমীরা, সুনীল ছেত্রীর গোল। ডান দিক থেকে মহেশের ক্রসে বল পেয়ে বাঁ দিক থেকে কোলাসোর পাঠানো ক্রসে শৈল্পিক হেড ফ্লিকে অসাধারণ, সুনীলোচিত গোল দেখতে পান গ্যালারির উৎসাহী দর্শকেরা (৩-০)।
তাঁর গোলের মিনিট পাঁচেক পর, ৮২ মিনিটের মাথায় সুনীলকে তুলে নেন ভারতীয় দলের কোচ মানোলো মার্কেজ। তুলে নেন কোলাসোকেও। নামেন আশিক কুরুনিয়ান ও ইরফান ইয়াডওয়াড। শুভাশিসের জায়গায় অভিষেক হয় অভিষেক সিংয়ের।
ব্যবধান আরও বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল ভারত। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার চার মিনিট আগে বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নেন মহেশ, যায় অসাধারণ দক্ষতায় সেভ করেন গোলকিপার হুসেন। পাঁচ মিনিটের সংযুক্ত সময়ের শেষে মহেশের কর্নারের পর বক্সের বাইরে থেকে গোলে শট নেন আপুইয়া, যা অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়