
গৌতম রায়
২
রাসমেলার মাঠে এই বানজারাদের জীবনটা ছিল হাসিতেই ভরা। দুঃখ কে ঘিরে দুঃখ বিলাসের সময় ওঁদের ছিল না। বরঞ্চ দুঃখ মোচনের তাঁদের মত করে চেষ্টাটাই ছিল প্রবল। শহুরে কেতায় পোষাকের শালীনতা ঘিরে যে ধরণের চলতি প্রথা আছে, এই বানজারা মেয়েরা সেসবের একদমই ধার ধারতো না। শাড়ি পরার রেওয়াজই তাঁদের মধ্যে বেশি ছিল। কিন্তু বিন্যস্ত আঁচলের প্রতি তাঁদের থাকতো না তেমন নজর। শাড়ি পরে আঁচল দিয়ে বুক ঢেকে রাখার যে শহুরে কেতা, যে কেতায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের রমণীরা তাদের মরদদের রুটি রুজির টানে চটকলিয়া শহরে এসে ভিড় জমিয়েছে, তারাও ক্রমে ক্রমে বাঙালি মেয়েদের মত শাড়ির বিন্যাস শিখে নিয়েছিল। যদিও তাঁদের শাড়ি পরাবার ধরণটা ছিল দেহাতি আঙ্গিকেই।
আঙ্গিকের এই বৈশিষ্টটা কিন্তু দেখা যেতো না বানজারা মেয়েদের মধ্যে। সেকালে কুঁচিয়ে শাড়ি পরাকে অনেকে বলতেন, ড্রেস দিয়ে শাড়ি পরা। তেমন ভাবেই শাড়ি পরতেন এই বানজারা মেয়েরা। কিন্তু শাড়ি দিয়ে সচেতন ভাবে বুক ঢেকে রাখার চল তাঁদের ছিল না। কাউকে আকর্ষিত করতে এমন ভাবে তারা শাড়ি পরতো তা কিন্তু নয়। এভাবে যে আকর্ষণ করা যায়, সেই বোধ বা ধারণা এসব মেয়েদের ছিল কি না তা জানা নেই। যেটা দেখা যেত ওভাবেই কাঁখে একটা সন্তানকে নিয়ে তারা রাস্তায় চলেছে। কখনো কারো কাছে খাবার চাইছে। পয়সা-কড়ি সাধারণত তারা চাইতো না। চাইতো খাবার। আবার পথচলতি সময়ে কাঁখের বাচ্চাটা কেঁদে উঠলে স্তন অনাবৃত করে সেখানে শিশুর মুখটিও গুঁজে দিতো। এই স্তনদান ঘিরে কে দেখছে, কে কি বলছে নিজেদের মধ্যে সেসব নিয়ে এঁদের কোনও মাথা ব্যথাই ছিল না।
বানজারাদের বেঁচে থাকা ঘিরে এই ছোট্টো মফঃস্বলল শহরে কারোরই তেমন মাথা ব্যথা ছিল না। ওঁদের দরিদ্র এতটাই করুণ ছিল যে, চটকলের বদলি লেবার থেকে শুরু করে রিক্সাওয়ালা — এই গরীব মানুষেরাও ওঁদের বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই দেখতো। উত্তর কলকাতায় পুরনো কোলকাত্তাইয়াদের মধ্যে ‘নিকিড়ি’ কথাটার বেশ প্রচলন ছিল এককালে। ভিখিরির থেকেও অধম বোঝাতে এই ‘ নিকিড়ি’ কথাটা ব্যবহৃত হত। পুরনো বাগবাজারীদের মধ্যে এই ‘নিকিড়ি’ কথার চল এখনও কিছুটা থেকে গেছে। অপছন্দের পাড়াকে ‘নিকিড়িপাড়া’ বলবার রেওয়াজ বাগবাজারের মানুষদের মধ্যে অনেকেরই আছে।
আমাদের মফঃস্বল শহরের বাঙালি-অবাঙালি হা-অন্ন মানুষজনেরা এই বানজারা, কাকমারাদের নিজেদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের থেকে অনেক অনেক নীচে অবস্থিত উদ্ভট জীব বলে মনে করতো। ব্যাপারটা অনেকটা ওই উত্তর কোলকেতার ‘নিকিড়ি’ লব্জের মত আর কী !
তবে এই বানজারারা যখন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটিতে মেতে উঠতো, তখন সেটা দেখে উপভোগ করার ব্যাপারে ভদ্দরলোক আর গরীব গুর্বের মধ্যে তেমন একটা ফারাক থাকতো না। কারণ, কাকমারাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া অচিরেই রূপ নিতো ভয়ঙ্কর মারামারিতে। হাতের কাছে যা পেত, তা নিয়েই অপরকে আঘাত, রক্তারক্তি একদম। এগুলো ছিল ওদের ঝগড়ার একটা রোজকারের ঘটনাক্রম। মারামরি দেখতে যে ভদ্দরলোকেদের এত উৎসাহ, বানজারাদের ঘিরে হইহুল্লোড়ের আগে আমার জানবার সুযোগ হয় নি।
বানজারাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া যত না হতো, মারামারিটা হতো তার থেকে ঢের বেশি। আর মারামারি মানে রক্তারক্তিটা ছিল ওদের ঝগড়াঝাটির একটা বিশেষ অংশ। মেরেধরে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে একে অপরকে। দুজনেই দুজনকে কামড়ে, খিমচে একাকার করে দিচ্ছে। কেউ হয়তো অজ্ঞান হয়ে অনেকটা সময় জুড়ে পড়ে আছে রাস্তায়। অনেকক্ষণ ধরে তার নট নঢ়ন চড়ন দেখে ওদেরই মধ্যে কেউ হয়তো একটা বড় গামলা বা হাড়ি করে জল এনে ঢেলে দিচ্ছে সেই রক্তাত্ব লোকটির গায়ে।
আবার বিকেলেই দেখতে পাওয়া যাবে- সেই আহত পুরুষ বা রমণী ওই রাসমেলার মাঠের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ঘোষপাড়া রোডের উপরে বসে আছে। দলের অন্যদের সঙ্গে তাদের ভাষায় আমোদ করছে। কাঁখের সন্তানটিকে স্তন পান করাতে করাতেই আর একটু বড় সন্তানটি খেলতে খেলতে যাতে না বাস-লরির নীচে চলে যায় সে দিকেও তীক্ষ্ম নজর রাখছে।
নগর সভ্যতার অতি আধুনিকতায় এখন আর রাসমেলার মাঠে তাঁবু ফেলে না এইসব কাউয়ামারা সম্প্রদায়ের লোকেরা। রাসমেলার মাঝের অর্ধেকটা এখন নানা বিত্তশালীদের বাড়ি। আমাদের এই শহরের সল্টলেক বলে লোকের মুখে মুখে ঘোরে। এই মফঃস্বলি সল্টলেকেরই বাসিন্দা ছিল চন্দন। রেলে চাকরি করতো। বেশ ভালো ছেলে। আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমিও গেছি ওঁদের বাড়ি। খুব স্নেহশীলা ওঁর মা। চন্দনের ছিল বেড়ানোর নেশা। ট্রেকিং ও করতো। একবার দল বেঁধে গেল দিঘাতে। নিস্প্রাণ ফিরে এলো। চন্দনের মৃতদেহের প্রতীক্ষায় ওঁর বাড়ির সামনের রাস্তায় আমরা বন্ধুরা মিলে দাঁড়িয়ে আছি– এটা ভাবতেই বেশ মন খারাপ লাগে।
চন্দন চলে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে ওঁর মা নিজেকে সামলান। তখনও রাস্তায় টটোর চল হয়নি। সবে অটো নেমেছে দু একটা। রিক্সাই সাধারণ মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম। দেখতাম চন্দনের মা বাজার করে ফিরছেন। দেখলেই একগাল হাসতেন। বেশ কিছুকাল আগে এক পশু চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি একটা দেশি কুকুর নিয়ে এসেছেন দেখাবার জন্যে। ওঁদের বাড়িতেই কুকুরটা থাকে।
তারপর আর মাসীমার সঙ্গে দেখা হয় নি। জানি না, উনি আছেন কি না। কী শান্ত পাষাণ প্রতিমা যে ছিলেন তিনি – লিখে বোঝানো যাবে না। চন্দন বেঁচে থাকতে এই মানুষটিই কতো হাসিখুশি ছিলেন। আমরা ওঁদের বাড়ি গেলে কেবল চা নয়, নিজের হাতে কিছু না কিছু তৈরি করে খাওয়াতেন। বাড়িতে যদি তেমন কিছু মজুত না থাকতো তবে সুজি। এমনকি লুচি ভেজে দিয়েছেন গরম গরম। লজ্জা পাওয়া মুখে বলেছেন, দেখো বাড়িতে তেমন কিছু আজ নেই। বাজারে যাই নি। তাই আলুভাজা আর চিনি দিয়েই খাও।
চন্দনদের বাড়িটা ছিল রেল লাইনের ধারে। ওঁদের ছাদে কত চড়ুইভাতি করেছি ইস্কুল জীবনে। কলেজ জীবনেও করেছি। চন্দনের দুই দাদা ছিলেন। শুনেছিলাম, ওঁরা চন্দনের বৈমাত্রেয় ভাই। তবে ওঁদের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে চন্দনের মাকে কখনও উনিশ- বিশ দেখিনি। চন্দন চলে যাওয়ার পর ওঁর দাদারা যেভাবে মাসীমাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, তা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক।
রাসমেলার মাঠের যে অংশটা ছোট ছোট প্লট করে বিক্রি হয়েছিল, সেখানে খানিকটা জমি কিনেছিল শিউপ্রসাদ সাউ। শিউপ্রসাদ ছিল আমার দিদিমার বাড়ির ভাড়াটে। বিহার থেকে আসা এই লোকটি চাকরি পেয়েছিল আমাদের বাড়ির পাশেই জে এন বিদ্যালয় নামে একটা প্রাইমারি স্কুলে। হিন্দি মাধ্যমের স্কুল। সাতের দশকের গোড়ায় এই স্কুলটা চালু হয়েছিল। মূলত চটকলের শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্যেই তৈরি হয়েছিল স্কুলটা। এই স্কুলটারও আগে চটকলের কুলিলাইনে একটা প্রাইমারি স্কুল অবশ্য ছিল। সরকার অনুমোদিত কিনা- তা ঠিক এখন আর মনে নেই। তবে আন্দাজ হয়, সরকারি অনুমোদন স্কুলটার ছিল না। তার কারণে সাতের দশকের মাঝামাঝিই সেটা অবলুপ্ত হয়ে যায়।
আসলে এই চটকলে কাজ করা কুলি-কামিনদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো শিখবে- এটা তখনকার সময়ের একটা বড় অংশের সমাজপতিরা মনেই করতো না তেমন ভাবে। ভিন রাজ্য থেকে আসা এইসব মানুষদের জীবনযাপন ঘিরে তখন কি সরকার বাহাদুর, কি সমাজপতি, কারোরই তেমন একটা মাথাব্যথা মোটের উপর ছিল না।
এইসব কুলিকামিনদের বস্তিজীবন কেমন ছিল সেকালে সমরেশ বসু তাঁর ‘বি টি রোডের ধারে’ তে লিখে গেছেন। তবে তাঁর ওই উপন্যাসে রয়েছে চটকলে কাজ করতে আসা বিভিন্ন রাজ্যের মানুষদের কথা। হিন্দিভাষী মানুষদের বাইরে আরও বহু ভাষী মানুষদের একত্র যাপনচিত্রের কথা সেখানে আমরা পাই। তাঁদের মধ্যে নানা ধরণের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভিতরেও আমরা দেখি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের একটা স্পষ্ট প্রভাব। প্রত্যেকটি মানুষই সেখানে নিজের নিজের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে রক্ষা করবার প্রতি যত্নবান। সেই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি অন্য অঞ্চলের মানুষদের কিন্তু কোনও বীতরাগের ছবি সমরেশের ওই আখ্যানকালে ছিল না।দেশের অতি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের সময়কালের আগে এমনটাই ছিল দস্তুর। তবে আমার বাড়ির খুব কাছে যেসব কুলিকামিনদের বস্তি গুলো চিল, সেখানে বিহার, উত্তরপ্রদেশের মানুষদের সংখ্যাই ছিল বেশি। হিন্দিভাষীদের মধ্যেও সংস্কৃতিতে, কথা বলার রীতিনীতিতে, ধর্মীয় আচার পালনে যে নানা ধারা আছে– কোনও ইউনিফায়েড ‘হিন্দি’ নেই, ‘হিন্দি সংস্কৃতি’ নেই, সেটা এইসব গরীবগুর্বো মানুষগুলোর সঙ্গে নিবিড় ভাবে মিশলে খুব ভালো বুঝতে পারা যায়।
হিন্দু বাঙালিরা ‘ছট পুজো’ আর হিন্দিভাষী মানুষদের এক করে দেখতেই বেশিরভাগ সময় অভ্যস্থ। কিন্তু এই দেখাটা খুব ভুল। ছট পুজো মূলতঃ বেশি প্রচলিত বিহারে। বিভক্ত বিহার , অর্থাৎ ঝাড়খন্ডেও। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ বা উত্তরাখন্ডে হিন্দিভাষী মানুষদের মধ্যে এই ছট পুজোর প্রচলন নেই বললেই চলে। উত্তরপ্রদেশে যে কোনও জায়গায় ছট পুজো দেখা যায়, একটু অনুসন্ধান করে দেখলে দেখা যাবে যে, যাঁরা এই পুজো করছেন, তাঁরা কখনও না কখনও বিহারের মানুষ ছিলেন। হয়তো তাঁদের পূর্বপুরুষেরা রুটি – রুজির তাগিদে বিহার থেকে এসে এখন বসবাস করছেন উত্তরপ্রদেশে, উত্তরাখন্ডে।
চটকলের শ্রমিকদের ছেলেপিলেদের ‘পঢ়াই’ করা দরকার- এই বোধটা চটকলিয়া এলাকার কিছু মুরুব্বি গোছের মানুষদের মাথায় এলো। পাল-মালোদের পাড়ার লাগোয়াই এই চটকল, সেখানকার কুলিবস্তি। কিছু প্রাইভেট বস্তি ও আছে। মানে ব্যক্তি মালিকানাধীন বস্তি। একটা বড় কারখানা চললে, তাকে ঘিরে আরও বহু রকমের রুটি-রুজির কারবার চলে। চায়ের দোকান, ঝুপড়ি হোটেল, তেলেভাজার দোকান, মন্দির, রিক্সা- ভ্যান থেকে বারোদুয়ার। চটকলে যারা গতর খাটিয়ে খায়, তারা যে প্রত্যেকেই চটকলের কুলি লাইনে ঘর পায়, তা তো আর নয়। আবার অনেকে চটকলের কুলি লাইনের এজমালি থাকার ব্যাপারটাকে ঠিক মন থেকে মেনে নেয় না। আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও চটকলের বিহারী শ্রমিকের বিদূষী ঘরণী ছিল। এই মুহূর্তে এমন একজনের কথা মনে পড়ছে- দেওসুন্দরী দেবী। যদিও তাঁর পৈতৃক নাম চাপা পড়ে গেছিল, রাজকুমারের মা, এই নামের আড়ালে। এই দেওসুন্দরীর গল্প পরে করা যাবে।
এমনতরো কিছু কিছু মানুষ ছিল, যারা একটু অন্যভাবে জীবন কাটাতে চাইতো। বিহার – উত্তরপ্রদেশের ছাপড়া, সিউয়ান, বালিয়া, মোতিহারির একেবারে গাঁওয়ালি বেরাদর অতিক্রম করে বাংলা-বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিকতাকে তারা কিছুটা আত্মস্থ করবার চেষ্টা করতো। এই আধুনিকতার ক্ষেত্রে সবার প্রথমে যেটা তাঁরা আত্মস্থ করবার চেষ্টা করতো, সেটা হলো পরিচ্ছন্নতা। যাকে এককথায় বলা যায়, হাইজেনিক জীবন যাপন।
দেহাতি জীবনযাপনের মধ্যে যে স্বাস্থ্যবিধির অভাব ছিল, সেটা এইসব মানুষেরা কলকাতার উপকন্ঠের শহরতলিগুলোতে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে বুঝতে শেখে। প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে যে কোনও মানুষ অন্তরের শিক্ষা, যাপনজনিত শিক্ষা বুঝে উঠতে সক্ষম হয় না– শহুরে মানুষদের এই ভুলটা খুব ভালো করে বুঝতে পারা যায় এইসব কুলিকামিনদের পরিবারগুলির দিকে একটু ভালোভাবে নজর দিলে। (ক্রমশঃ)