
সুমন গঙ্গোপাধ্যায় : দিল্লী গেলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। ইস্যু সেই বহুল প্রচলিত ‘বঞ্চনা’। বিশেষ করে ১০০ দিনের কাজ সহ একাধিক ক্ষেত্রে পাওনা আদায়ের দাবী সরাসরি
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে দেখা করবেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যের বিভিন্ন জনকল্যাণ প্রকল্পের বরাদ্দ আটকে দিয়েছে কেন্দ্র। আর সেই বকেয়া অবিলম্বে মিটিয়ে দিতে হবে। না হলে গদি ছাড়তে হবে বিজেপিকে। মনরেগা, স্বাস্থ্য, আবাসন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের টাকা আটকে রয়েছে। এমনকী, জিএসটি বাবদ আয় থেকে রাজ্যের প্রাপ্য অংশও দেয়নি। ২০ ডিসেম্বর প্রাপ্য আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি l একজন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর রাজ্যের পাওনা অর্থ চাইতে দিল্লি যেতেই পারেন, তবে সেটাই যদি এক ও একমাত্র লক্ষ থাকত , তাহলে হয়তো এই প্রতিবেদন লিখতে হতো না l রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন, শুধুই, শুধুই কি দাবি আদায়? নাকি এর পিছনে ও কাজ করছে অন্য এক অঙ্ক।
১০০ দিনের কাজ সহ যে যে দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্মৃতি যদি খুব একটা বিচ্যুত না হয় তাহলে ঠিক এই এই দাবি নিয়ে খোদ রাজধানীতে রীতিমত ঝড় তোলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী খোদ কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রীর অফিসের সামনে দলীয় সাংসদ দের নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিক্ষোভ এমন আকার নেয়, বাধ্য হয়ে পুলিশ কে হস্তক্ষেপ করতে হয়
রাজভবনের সামনে ১৪৪ ধারার মধ্যে ও অবস্থান বিক্ষোভ ও করে রাজ্যের শাসক দল। আর এজন্যেই প্রশ্ন। যে ইস্যুতে তৃণমূলের ‘ যুবরাজ’ খোদ ময়দানে, সেখানে সেই একই দাবী নিয়ে ঠিক লোকসভা ভোটের আগে আগে দিল্লি গেলেন কেন মুখ্যমন্ত্রী? রাজনৈতিক মহল এখানে একটা অন্য সমীকরণ খুঁজছেন। সম্প্রতি ৩ রাজ্যের নির্বাচনেই মুখ থুবরে পড়েছে কংগ্রেস। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্ডিয়া জোটে ‘ মহামন্ত্রী ‘ ভূমিকা নেওয়া কংগ্রেস এই তিন রাজ্যের ফলাফলের পর অনেকটা ব্যাকফুটে l তার প্রমাণ ও মিলেছে, নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকারজুন খারগের রাইসিনা রোডের বাড়িতে ডাকা ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক শেষ পর্যন্ত শরিক দের চাপে বাতিল করতে হয়। যার মুখ্য ভূমিকাতে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী আলোচনা ছাড়া কংগ্রেসের ডাকা এই বৈঠক নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ ও প্রকাশ করেন তিনি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্ডিয়া জোটের সবথেকে বড় শরিক কংগ্রেস কিছু টা হলেও দুর্বল হয়ে পড়ায় জোটের নিয়ন্ত্রণ এবার নিজের হাতে নিতে চাইছেন প্রশাসক হিসাবে দক্ষ , অভিজ্ঞ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ওজনে জোটের অন্যতম প্রধান ‘হেভিওয়েট’ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। গোটা দেশের শাসক ও বিরোধী পক্ষের প্রায় প্রথম সারির সব নেতা- নেত্রী র সাথেই সুসম্পর্ক দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর। আর গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী জোড়ালো মুখ হিসাবেও এগিয়ে তিনি। তাই এই মুহূর্তে অনেকটাই advantage মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মোদ্দা কথা দিল্লীর মসনদকে টার্গেট করছেন বাংলার নেত্রী।
আজ ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে কি ঠিক কোন পথে এগোবে ইন্ডিয়া জোট তা স্পষ্ট হয়ে যাবে মঙ্গলবার এর বৈঠকেই এমনকি গোটা দেশজুড়ে ইন্ডিয়া জোট এর দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরী হবে এই বৈঠকেই। আর ঠিক তার আগে আগে খোদ দিল্লিতে বসে একাধিক ইস্যুতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে নিজেকে মুখ হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন মমতা। পাঠক, একটু লক্ষ করে দেখুন সোমবারের কুনাল ঘোষের সাংবাদিক সম্মেলন। এতদিন যে তৃণমূল বলে আসছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখ কে হবেন তা বাকি শরিকদের সাথে আলোচনা করেই ঠিক হবে। এমনকি খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার টার্গেট নয়। আর নেত্রী যখন দিল্লি,মঙ্গলে যখন ইন্ডিয়া জোটের হাই ভোল্টেজ বৈঠক ঠিক তার আগেই তৃণমূলের মুখপাত্র স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন জ্যোতি বসু কে প্রধান মন্ত্রী না হতে দেওয়ার মতো যে ভুল সিপিএম করেছে, সেই ভুল তৃণমূল তারা করবে না।
রবিবারই তিনি দাবি করেছিলেন, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর মুখ্যমন্ত্রী হবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলেন, ” যদি এর মাঝখানে মমতার হাতে দিল্লিতে কোনও গুরুদায়িত্ব চলে আসে, তাহলে রাজ্যের দায়িত্ব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নেবেন।”
প্রসঙ্গত, বাংলায় ৩৪ বছরের বাম জমানায় একটি বড় অংশজুড়ে ছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। অতীতে ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার বিষয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। শোনা যায়, সেই সময় সায় দেয়নি সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার স্বপ্ন হাতছাড়া হয়েছে বঙ্গবাসীর। কিন্তু কুণাল ঘোষ বুঝিয়ে দিলেন, সেই ‘ঐতিহাসিক ভুলের’ পথে এগোবে না তৃণমূল শিবির।
তৃণমূল মুখপাত্র বললেন, “তৃণমূল কংগ্রেস জ্যোতি বসুর পার্টির মতো ঐতিহাসিক ভুল করবে না। যদি দেশকে পরিচালনার চ্যালেঞ্জ সামনে আসে, যদি দেশবাসী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চান, তখন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।”
অর্থাৎ খুব স্পষ্ট, মুখে যাই বলুক তৃণমূল। তিন রাজ্যে নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়ার পর ব্যাকফুটে থাকা কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়িয়ে ইন্ডিয়া জোটের রাস নিজের হাতেই রাখতে চাইছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি তৃণমূল পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, যদি সুযোগ আসে তাহলে ইন্ডিয়া জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিটেস্ট এক ও একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।