
অপরূপা কাঞ্জিলাল : ২৪ শে জুলাই ২০২৪ দেশের সম্মান এক অন্য মাত্রা ছুঁয়েছে। দেশের মেয়ে মনু ভাকর দেশের জন্য নিয়ে এলেন ব্রোঞ্জ তাও একটি নয় দু দুটি। তার জয়ের আনন্দে আনন্দিত সকলে গর্বিত একজন ভারতীয় হিসাবে। কিন্তু এই জয়ের পিছনের যে গল্পটা রয়েছে অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি ২০২৪ এর আগে ২০২১ এর কথা। অথবা তারও অনেক অনেক আগের কথা যা বারবার বিফল হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া এক যুদ্ধ ফেরত সেনা নায়ক কে আবারো যুদ্ধ জয় করতে যাওয়ার সাহস যোগায় সেই কাহিনী। ধরুন, আপনার পুত্র বা কন্যাটি স্কুল লেভেলে বক্সিং, মার্শাল আর্ট, ভলিবল, টেনিস ইত্যাদি নিয়ে মেতে আছে। হঠাৎ একদিন চোখে মারাত্মক চোট পেয়ে এসে বললো “বক্সিং, মার্শাল আর্ট আর করবো না। আমাকে একটা এয়ার পিস্তল কিনে দেবে, শ্যুটিং প্র্যাক্টিস করবো ?”
আপনি কিনে দেবেন ? দেবেন না। বরং বলবেন “অনেক হয়েছে খেলাধুলো এবার পড়াশুনোয় মন দে”। বলবেন না ? আসলে কিন্তু এইটা বলাটাই স্বাভাবিক সাধারণ পরিবার কিন্তু এভাবেই ভাবে। তাই তারা হয়তো এটাই বলবেন কিনতু পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রামকিষান ভাখর তা বলেননি। মেয়ের জন্য নিজের সঞ্চয় ভাঙতে দুবার ভাবেননি তিনি। বরং এক লক্ষ চুরাশি হাজার টাকা দিয়ে একটি এয়ার পিস্তল কিনে এনে দিয়ে বলেছিলেন “যা, অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদী হ !” ভাবুন তো একবার এমন তো হতেই পারতো যে এই অর্থ ব্যয় কোনো কাজে এলোনা। জীবনের অনেকটা সময় ধরে করাই সঞ্চয় হয়তো শুধুই জলে গেল। অনেকেই হয়তো পিছিয়ে আসবেন এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে কিন্তু কন্যার উপর ঠিক কতটা বিশ্বাস থাকলে একজন বাবা এটা করতে পারেন যেটা রাম-কিষণ ভকর পেরেছিলেন। যেখানে তিনি কিনতু জানতেন যে কন্যাটি জীবনে কখনো এয়ার পিস্তল হাতেই ধরেনি?
শুরু হলো লক্ষ্যভেদের শিক্ষা পর্ব। ধীরে ধীরে গুরুর থেকে শিক্ষা লাভ করে মেয়েটি বিশাল বড় লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠলো এমনটা যদি ভাবছেন তাহলে কিন্তু ভুল মোটেই এত সহজে বিষয়টা হলো না। সেই মেয়েটি একদিন তার কোচের সঙ্গে ঝগড়া করে তার কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিলো। শুধু তাই নয় স্পেয়ার পিস্তল ছাড়াই অলিম্পিকে গিয়ে পৌঁছল। সময়ের কেমন খেলা অলিম্পিকে পিস্তলটি বিগড়ে যাওয়ায় ১২ তম স্থান পেয়ে, দেশে ফিরে এলো সে। কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং প্রতিজ্ঞা করে যে জীবনে আর কখনো পিস্তল হাতে নেবে না, এমতাবস্থায় সন্তানকে এভাবে হেরে যেতে দেখে গড়পড়তা একজন ভারতীয় মা কী বলবেন ? বলবেন “অনেক হয়েছে। এবার বিয়ে করে সংসার কর !” সত্যিই তো যে বিষয় নিয়ে নিয়ে বারে বারে সমস্যায় পড়ছে ভেঙে পড়ছে হতাশা ঘিরে ধরছে তাকে সে কাজ করা কেন? বিশেষ করে যখন সন্তানের এমতাবস্থা একজন মা হয়তো তাকে অন্য কোন দিকে মনোনিবেশ করতে বলবেন যাতে খানিকটা ভুলে থাকা যায়।
এই মেয়েটির মা কিন্তু তা বলেননি। ইনি যে অন্য ধাতুতে গড়া। ইনি এমন মা যিনি মেয়ের জন্মের দুদিন পরেই সদ্যোজাতকে বাড়িতে রেখে বি-এড পরীক্ষা দিতে গেছিলেন। মেয়ের চরম ডিপ্রেশনে, তাই এই হাইস্কুল প্রিন্সিপাল, রাতের পর রাত মেয়েকে গীতা পড়ে শুনিয়েছেন। বলেছেন :
“যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা”
অর্থাৎ, তিনিই প্রজ্ঞা লাভ করেছেন যিনি ভালো এবং মন্দ দুটি থেকেই সমানভাবে দূরত্ব বজায় রাখেন এবং দুটি থেকেই প্রভাব মুক্ত থাকেন।
গীতার প্রসঙ্গে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মতামত থাকতেই পারে। যারা আস্তিক তারা একরকম বলবেন যারা নাস্তিক তারা আর একরকম। গীতার বাণী সেতো চিরন্তন সত্য এবং যথার্থ। আস্তিক মন নিয়ে দেখলে ভগবানের মুখ নিঃসৃত বাণী নাস্তিকের মন নিয়ে বুঝলে অসাধারণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ক্ষুরধার বুদ্ধির একশ চতুর ব্যক্তির বাস্তব জ্ঞান লাভ। আসলে জীবনে এগিয়ে যাবার পথ সাহস এবং দৃঢ়তা যোগানোর এক আধার। জীবন এক সংগীতের মত সুরের ভিন্নতা দিয়েই নতুন সুর সৃষ্টি। এই নতুন সুরেই জীবনকে বাঁধার জন্য এই মা, মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভায়োলিন।
আর বাবা রামকিষান? তিনি কি করেছিলেন তিনি মেয়ের এই পিছিয়ে পড়া সময়ে নিজের ফোনটা এনে কন্যাকে বলেছেন “আমাদের পরে যদি কেউ তোকে সবচেয়ে ভালো বোঝেন তো তিনি হলেন তোর ছোটবেলার কোচ যশপালজী। নে, ফোন কর। ক্ষমা চেয়ে নে। গুরুর কাছে ক্ষমা চাইবি তাতে লজ্জা কিসের ? গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরু দেব মহেশ্বর। কাল থেকে আবার ওনার কোচিংয়ে যা। আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।”
আপনি- আমি পারবো এমন কথা বলতে ? পারবো না। বরং হয়তো অনেকেই বলবেন “উনি আর কী এমন কোচ ? ওনার থেকেও ভালো কোচ খুঁজে আনছি !” আজকালকার দিনে দেখতে গেলে এটাই বাবা মা এদের স্বাভাবিক মন্তব্য। শিক্ষক শিক্ষাগুরু তাদের দেওয়ার শিক্ষা বর্তমানে হয়তো অর্থের মূল্যে মূল্যায়িত হয়। প্রাচীন সময়ের গুরু শিষ্যের সেই সম্পর্ক আর কোথায়? তবে শুধু খুব প্রাচীন বললেই নয় বেশ কয়েকটা বছর আগেও শিক্ষক এবং গুরুর স্থান কিন্তু অনেকটাই অন্যরকম ছিল। তবে দিন পাল্টেছে সমাজ পাল্টাচ্ছে। পালটাচ্ছে ভাবনার ধরন। তাই বোধহয় এই ধরনের কথাই বাবা-মা এটা বলে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে এই বাবা এমনটা বলেন নি বরং বলেছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত কথা।
মেয়েটিও কিন্তু বাবার কথায় তার পুরোনো কোচকে ফোন করে এবং চোখের জলে ক্ষমা চেয়ে নেয়। গুরু ক্ষমা করেন আবার শুরু হয় গুরু-শিষ্যার লক্ষ্যভেদ প্র্যাক্টিস। যা শেষ হয়, প্যারিস আলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয় দিয়ে।
মানু ভাখর, প্রথম মহিলা শ্যুটার যিনি ভারতের জন্য একই অলিম্পিকে দুটি পদক জিতেছেন। ইতিহাসে হয়তো এটাই লেখা থাকবে। সংবাদ মাধ্যম থেকে রাজ্য দেশ সকলেই মনু ভাকরকে চিনবে। পাতায় পাতায় তারই নাম লেখা থাকবে। কিন্তু লেখা থাকবে না এই তিন গুরুর কথা যারা না থাকলে এই মেয়েটির ডিপ্রেশনের অতলে তলিয়ে যাবার কথা ছিল, কথা ছিল এয়ার পিস্তল ছেড়ে, বেলন-চাকী চালানোর।
লেখা থাকবে না পদক জয়ের পর সাংবাদিক সম্মেলনে এসে দাঁড়ানো মাত্র সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করেন “মাত্র ০.১ পয়েন্টের তফাতে সিলভার হাত ছাড়া হলো – দুঃখ হচ্ছে না ?” তার জবাবে, মাত্র ২৪ বছরের মেয়েটি কেন গীতার সেই অমোঘ শ্লোকটিই বলেন : “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন !”
সর্বশক্তি উজাড় করে কর্মে মন দিতে হয়। ফল সে তো আপেক্ষিক। কিন্তু কর্ম চিরঞ্জীবী মানুষকে তার কর্ম অমর করে দিতে পারে। আর এই কর্মের পথে আঘাত পেলে হতাশা এলে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সাহস এবং দৃঢ়তা এই তিন শক্তির আধার হয়ে যারা দাঁড়াতে পারেন তারাই হয়তো একই ইতিহাসের রচয়িতা হন। এমন বাবা মা হয়তো বা এমন পরিবার হয়তো প্রয়োজন। তাহলে হয়তো কালো কালো রঙের পরদ সরিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে এক একটি কহিনুর।