
শুভাশিস চট্টোপাধ্যায়ঃ মাঝ রাত্তিরে একটা ফোন রোধ করে দিয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ২টোর সময় ফোন পেয়ে জেগে উঠেছিলেন পাকিস্তানে কর্মরত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অজয় বিসরিয়া। ফোন করেছিলেন ভারতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সোহেল মাহমুদ। উদ্বিগ্ন সোহেল মাহমুদ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়াকে জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলতে চান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। প্রসঙ্গত পুলওয়ামাতে ভারতীয় জওয়ানদের উপর জঙ্গি হানার রেশ তখন দগদগে। তার আগের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ডগ ফাইটে পাকিস্তান সেনার হাতে ধরা পড়েছেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপায় সেনা এবং বিদেশমন্ত্রক। কিন্তু প্রথমে পাকিস্তান উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতের হাতে ফিরিয়ে দিতে রাজি ছিল না। দরাদরির চেষ্টা চালাচ্ছিল তারা। তারপরই ভারতের তরফ থেকে দেওয়া হয় চূড়ান্ত হুমকি। অবিলম্বে উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি না দেওয়া হলে পাকিস্তানের বুকে আরও বড় ধরনের সামরিক হামলা চালানো হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। ভারতের এই কঠোর অবস্থান আমেরিকা এবং ব্রিটেনকেও জানিয়ে দেয় সাউথ ব্লক। এরপরই টনক নড়ে ইসলামাবাদের। রাত দুপুরে পাকিস্তানে কর্মরত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়াকে ফোন করেন ভারতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সোহেল মাহমুদ। সোহেল মাহমুদ অবশ্য তখন জরুরি তলব পেয়ে ইসলামাবাদে ছিলেন।
এমনই চমকপ্রদ, রোমহর্ষক ঘটনার কথা নিজের সদ্য প্রকাশিত বই “অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টঃ দ্য ট্রাবলড ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান”-এ লিখেছেন প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়া। সোহেল মাহমুদের ফোন পেয়ে কি করেছিলেন অজয় বিসারিয়া? অজয় বিসারিয়া সেই ঘটনার কথা বিস্তারিত লিখেছেন। বইতে তিনি লিখেছেন তখনই বিদেশমন্ত্রকে তিনি পাক সরকারের বার্তা পৌঁছে দেন। বিদেশমন্ত্রক থেকে তাঁকে বলা হয়, এতো রাতে প্রধানমন্ত্রী ফোন ধরবেন না। তিনি ঘুমোচ্ছেন, ইমরান প্রশাসনের যা কিছু বক্তব্য তিনিই যেন শুনে নেন। এরপর অজয় বিসারিয়া ফোন করে নয়া দিল্লির বার্তা সোহেল মাহমুদের মাধ্যমে ইমরান প্রশাসনকে জানিয়ে দেন। সোহেল মাহমুদ সেই রাতেই অজয় বিসারিয়াকে বলেন ভারতীয় উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে শিগগিরি মুক্তি দেবে পাকিস্তান। পরদিন অর্থাত ২৮ ফেব্রুয়ারি সেই সিদ্ধান্তের কথা পাক পার্লামেন্টে ঘোষণা করবেন ইমরান খান। সেই বার্তা দিল্লিতে পৌঁছে দেবার পাশাপাশি দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে অজয় বিসারিয়াকে অনুরোধও করেন সোহেল মাহমুদ। নিজের সদ্য প্রকাশিত বইতে অজয় বিসরিয়া আরও লিখেছেন সেই রাতে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি সহ ৯টি সেনা ছাউনির দিকে ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়ন করে বসে ছিল। স্রেফ ছিল সবুজ সংকেতের অপেক্ষা। গ্রিন সিগন্যাল পেলে ১৫ মিনিটের মধ্যেই একসঙ্গে পাকিস্তানের ৯টি সেনাঘাঁটিতে আছড়ে পড়তো ভারতীয় মিশাইল। পরে ২০১৯ সালে একটি নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদি সেই দিনের কথা একবার মাত্রই উল্লেখ করেছিলেন। মোদি বলেছিলেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে না ছাড়লে সেদিনের রাত হতো ‘কাতিল কা রাত’। সরকারি ভাবে ভারত কখনই পাকিস্তানকে হামলার হুমকি প্রসঙ্গে কোথাও কিছু বলেনি, স্বীকারও করেনি। তবে নিজের বইতে অজয় বিসরিয়া লিখেছেন কঠোরবার্তাটা ইসলামাবাদের পাশাপাশি আমেরিকা এবং ব্রিটেনকেও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হয় উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের মুক্তি নয়তো ‘কাতিল কা রাতের’ জন্য প্রস্তুত থাকা। অজয় বিসরিয়া আরও লিখেছেন ভারতের বার্তা পাবার পর ইসলামাবাদ আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সচিবদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তৎকালীন পাক বিদেশ সচিব তেহমিনা জানজুয়া, কিন্তু হালে পানি পাননি তিনি। দুটি দেশ থেকেই বলে দেওয়া হয় জেনিভা কনভেনশনের রিতি অনুসারে যেন অভিজ্ঞান বর্তমানকে দ্রুত এবং অক্ষত শরীরে মুক্তি দেওয়া হয়। না হলে তাদের পক্ষেও আর কিছুই করার নেই। ভারতের রণংদেহী মুর্তি এবং পশ্চিম দুনিয়ার পাশ থেকে সরে দাড়ানোয় ভয় পেয়ে যায় ইসলামাবাদ। তড়িঘড়ি ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ফোন করে উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে শিগগিরি মুক্তির আশ্বাস দেন সোহেল মাহমুদ। পরদিন পাক পার্লামেন্টে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অভিনন্দন বর্তমানকে দুদেশের শান্তির স্বার্থে মুক্তির কথা ঘোষণা করেন। ইমরান পাক পার্লামেন্টে আরও একটা কথা সেদিন বলেছিলেন। ইমরান বলেছিলেন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছিলেন কিন্তু ব্যস্ততার জন্য মোদির সঙ্গে তাঁর কোনও কথা হয়নি। এই ভাবেই সেদিন শেষ মুহুর্তে বেঁচে গিয়েছিল দুদেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা। এতদিন পর যা নিজের সদ্য প্রকাশিত বই অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টঃ “দ্য ট্রাবলড ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান”-এ লিখলেন প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়া।