
নিজস্ব সংবাদদাতা, আলিপুরদুয়ার : আলিপুরদুয়ারে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মুখ করে যে জনসভার ডাক দিয়েছিল, তা যে আসলে বিজেপির ২৬শের চোখ তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ‘পরিবর্তন সঙ্কল্প সভা’ নামে। তাই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে তৃণমূল সরকারের তুলোধোনাই ছিল মূল লক্ষ্য। ‘অপারেশন সিঁদুরে’ সেখানে জাতীয়তাবাদী ক্যাটালিস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হল। রাজ্য বিজেপির নেতারাও আন্দাজ করতে পারেননি, নরেন্দ্র মোদী এসে তাঁদের কাজ এতটা সহজ করে যাবেন। এতটা জোরে বাজাবেন নির্বাচনের ভেরী। এমনি বঙ্গ বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও বোধ হয় আন্দাজ করতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এতটাই ভোটধর্মী হবে। তাই তিনি তাঁর সক্ষিপ্ত ভাষনে অনেকটাই আটকে গিয়েছিলেন ‘সিঁদুরে’।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নিশানা করেছেন। যেখান থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, আলিপুরদুয়ারের মঞ্চকে তিনি ২৬শের জন্যই ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তাই উচ্চ স্বরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে বার বার ‘নির্মম সরকার’ বলে আক্রমণ করেছেন। একই সঙ্গে রাজ্যের বিজেপি কর্মীদের এখনই ভোটের ময়দানে নেমে পড়ার উৎসাহ জুগিয়েছেন।
আবহাওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টার বাগডোগরা থেকে সিকিমের উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। বাগডোগরা থেকেই সিকিমের কর্মসূচিতে অংশ নেন ভার্চুয়াল মাধ্যমে। তার পরে আলিপুরদুয়ারে, নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা দুয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী পৌঁছে গিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে। প্রথমে প্রশাসনিক মঞ্চ থেকে আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার জেলার জন্য পাইপলাইনে রান্নার গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর যান ‘পরিবর্তন সঙ্কল্প সভা’র মঞ্চে।
মোদী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ এই মহূর্তে নানা সঙ্কটের আবর্তে রয়েছে। তিনি তা উল্লেখ করে জানান, সমাজে ছড়িয়ে পড়া হিংসা ও অরাজকতা, মা-বোনেদের নিরাপত্তার অভাব, তাঁদের উপরে অত্যাচার, যুবকদের মধ্যে ঘোর নিরাশা, বেকারত্বের যন্ত্রণা, দুর্নীতি এবং গরিবের অধিকার ছিনিয়ে নিতে থাকা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কার্যকলাপ।’’

এদিন প্রধানমন্ত্রী মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের অশান্তির প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগ তোলেন। তোপ দাগেন তৃণমূলের বিধায়ক, কাউন্সিলর, স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। মোদী বলেন, ‘‘মালদহ, মুর্শিদাবাদে যা হয়েছে, তা এখানকার শাসকদলের নির্মমতার দৃষ্টান্ত! তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এই ভাবে সরকার চলে” ? মোদী বলেন, ‘‘বাংলার মানুষের একমাত্র আশ্রয় এখন আদালত। সব বিষয়ে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।’’ এর পরেই মোদী তাল ঠুকে বলতে থাকেন, ‘বাংলার চিৎকার, লাগবে না নির্মম সরকার’।
এদিন চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি চাকরিহারা শিক্ষকরা। তবে তাঁর ভাষণে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠেছে। মোদী বলেছেন, ‘‘দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সবচেয়ে কুপ্রভাব যুবসমাজের উপরে পড়ে, গরিব আর মধ্যবিত্তের উপরে পড়ে। দুর্নীতির প্রভাব কী ভাবে পড়ে, তা আমরা শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেখেছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘হাজার হাজার শিক্ষককে শেষ করে দিয়েছে, তাঁদের পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে, তাঁদের সন্তানদের অসহায় করে দিয়েছে। এটা শুধু কয়েক হাজার শিক্ষকের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা নয়। পশ্চিমবঙ্গের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।’’ মোদী বলেন, ‘‘এত বড় পাপ তৃণমূলের নেতারা করেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও নিজেদের ভুল মানতে রাজি নন। উল্টে দেশের বিচারব্যবস্থাকে দোষী বানাচ্ছেন।’’

দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে চা বাগান শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও তুলেছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘পিএফ নিয়ে যা হয়েছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। গরিবের মেহনতের কামাইয়ের উপরে ডাকাতি করা হচ্ছে। তৃণমূলের সরকার দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।’’ তৃণমূল সরকারের ভুল নীতির কারণে একের পর এক চা বাগান বন্ধ হচ্ছে এবং শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন বলে মোদী বৃহস্পতিবার অভিযোগ তুলেছেন।
প্রদাধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে চালু হতে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতি নিজের জায়গায় রয়েছে। কিন্তু গরিব, দলিত, আদিবাসী এবং মহিলাদের সঙ্গে তৃণমূল কেন শত্রুতা করছে ? এসসি, এসটি, গরিব এবং মহিলাদের জন্য সারা দেশে যে সব প্রকল্প চলছে, সেগুলোকে এখানে কার্যকরীই হতে দেয় না।’’ মোদি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প কার্যকরী না হওয়ায় এ রাজ্যের বাসিন্দারা দিল্লি, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুতে গিয়ে নিখরচায় চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান না। দেশের সত্তরোর্ধ্ব সব নাগরিককে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনা অর্থে চিকিৎসা দিচ্ছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ নাগরিকদের সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত রাখা হয়েছে বলে মোদী অভিযোগ করেন।

তৃণমূলকে তুলোধোনা করে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী আসেন ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ। বাংলার সঙ্গে ‘অপারেশন সিঁদুরে’র সম্পর্ক কতটা ‘ঘনিষ্ঠ’, তা বোঝাতে বাঙালীর সিঁদুর খেলাকে টেনে আনলেন। মোদী বললেন, ‘‘আমাদের বোনেদের সিঁদুর ওরা মুছেছিল। আমাদের সেনা ওদের আমাদের সিঁদুরের শক্তি বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা সন্ত্রাসের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছি, যা পাকিস্তান কল্পনাও করতে পারেনি।’’
পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে গিয়ে এদিন তাঁর মুখে উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রসঙ্গও। ১৯৭১ সালের কথা মনে করিয়ে মোদী বলেন, ‘‘আজকের বাংলাদেশে ফিরে এসেছে পাকিস্তানের সন্ত্রাস, পাকিস্তানের সেনা বাংলাদেশে যে পরিমাণে ধর্ষণ আর খুন করেছিল, তা কেউ ভুলতে পারে না। সন্ত্রাস আর নরসংহার পাকিস্তানের সেনার সবচেয়ে বড় দক্ষতা।’’ তিনি বলেন, ‘‘সরাসরি যুদ্ধ হলেই পাকিস্তানকে শোচনীয় ভাবে হারতে হয়। তাই ভারতের সঙ্গে ওরা সরাসরি যুদ্ধ করতে চায় না, সন্ত্রাসবাদীদের দিয়ে ভারতের ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার পরে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, সন্ত্রাসী হামলা হলে পাকিস্তানকে তার চড়া দাম দিতে হবে। তিন বার পাকিস্তানকে ঘরে ঢুকে মেরেছি।’’