
কুশল চক্রবর্তী
আবার ভারতীয় রিসার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের রেপো রেট বা ব্যাঙ্ককে যে সুদে টাকা তারা ধার দেয় তার পরিমান কমাল। বলতে গেলে ব্যাংক থেকে ধার নিলে প্রদেয় সুদের পরিমান এখন কমবে প্রায় ৫%। এখন ব্যাঙ্ক বিভিন্ন কারণে যাদের টাঁকা ধার দেয় তাদের কাছ থেকে কম সুদ নিতে পারবে। প্রকারান্তরে সে কথাই বুঝিয়ে দিল আরবিআই। কিছু সাধারণ লোকের বাড়ির লোণ বা গাড়ির লোন শোধ দিতে এখন সুবিধা হবে। আবার যারা নতুন করে আগামীদিনে বাড়ি বা গাড়ির লোণ নিতে চাইবে তাদের গুণতে হবে কম সুদ। তার ফলে হয়ত, বাড়ি বা গাড়ি, লোণ নিয়ে এসব জিনিস কেনার চাহিদা বাড়বে। কিন্তু লাভ হবার কথা আনেক বেশি শিল্পপতি আর বড় ব্যবসায়িদের। কারন ব্যবসায়ি আর শিল্পপতিদের কম সুদে যাতে বেশি টাকা ধার দেওয়া যায় তার জন্য ব্যাঙ্কগুলোকে লগ্নি যোগ্য টাকার পরিমান বাড়াল রিসার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, সি আর আর বা ক্যাশ রিসার্ভ রেসিও কমিয়ে। অন্য দিকে, এর ফলে ব্যাঙ্কগুলোকে কমাতে হবে ফিক্সড ডিপসিটের উপর সুদের হার, যার ফলে অনিশ্চিত হয়ে যাবে, জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে থাকা, অজস্র সিনিয়ার সিটিজেনের আয়। কারণ পেনশান না থাকা এই মানুষগুলোর একমাত্র নিশ্চিন্ত আয়ের রাস্তা তো ব্যাংকের ফিক্সড ডিপসিটই। সরকার বা রিসার্ভ ব্যাঙ্ক বলছেন যে, জিনিসপত্রের দাম এখন এতই কম যে সুদ কমানো যেতেই পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ষাঠ বছরের বেশি বয়সের মানুষগুলোর সবচেয়ে বেশি খরচা বোধ হয় ওষুধেই হয়, তার দাম তো প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী ।
অন্যদিকে বাস্তবটা হচ্ছে এই যে ব্যাংকের মেয়দি জমাতে সুদ কমলেই ব্যাংকে গেলেই আপনি শুনতে পাবেন প্রকারান্তরে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের অণুরোধ। আর সত্যি বলতে কি সুদের হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকের তখন প্রতিবাদ করার জায়গাও থাকবে না। আর অধিক সুদের আশায় না বুঝে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে অনেক মানুষই যে বিপদে পড়বে, এটা আশঙ্কা করা যেতেই পারে। আর যত মিচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ বাড়বে তত শেয়ার মার্কেট আরও লোভনীয় হয়ে উঠবে। এমন সব দেখাবার চেষ্টা করে প্রতারকেরা আরও বেশি সরল বিশ্বাসী লোকেদের বিভ্রান্ত করবে। অন্যদিকে ব্যাংকের অসুবিধার কথায় আশা যাক। সুদের হার কমা মাত্র তাদের কাছে চাপ আসবে ব্যাংকের গচ্ছিত টাকা লগ্নি করার প্রয়াস বাড়ানোর। কারণ রিসার্ভ ব্যাঙ্ক সি আর আর ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে দিয়েছে। ফলে লগ্নি যোগ্য প্রায় ২.৫০ লক্ষ কোটি টাঁকা ব্যাংকের হাতে চলে আসবে। ব্যাঙ্কগুলোর দায়িত্ব থাকবে এই টাকার সঠিক লগ্নি করার।
দেশের পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার লগ্নি নির্ভর করে তৎকালীন শিল্পের পরিবেশের উপর। এখন ভারতের শিল্পের যা পরিবেশ তাতে নতুন করে লগ্নির জায়গা খুজতে ব্যাংকে মেহনত করতে হবে। কারণ গত কোয়ার্টারে শিল্প বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.৬%। এবং বলতে গেলে একেবারেই আশাপ্রদ নয়। এমনকি সদ্য সমাপ্ত বৈঠকে আরবিআই তা প্রকারান্তরে স্বীকারও করেছে। অন্য দিকে ভারত জুড়ে দেশের পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রায় সব শিল্পগুলোতেই আদানি আর আম্বানির রমরমা। এর মধ্যে আবার আদানি গোষ্ঠী, ভারতীয় অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলো থেকে ধার নিতে উৎসাহিত নয়। তাদের কর্ম কাণ্ডের ঋণের বেশির ভাগই আসে আবু ধাবি ব্যাঙ্ক বা বারক্লেস ব্যাঙ্ক বা ইংল্যান্ডের ব্যাঙ্ক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক থেকে। অতএব কোথায় লগ্নি করবে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলো ? আর মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী তো বন্ডের মাধ্যমে নিজেদের মূলধন যোগাড় করতেই বেশি উৎসাহী। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো ইদানীং ভরসা রেখেছিল মধ্যম আর ছোট ছোট শিল্প সংস্থাগুলোর ঋণের প্রতি।কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে মধ্যম আর ছোট শিল্পের এনপিএর হার কমলেও, সেটা থেকে একেবারে চিন্তা সরানো যাচ্ছে না। কারণ গতবছরই ব্যাঙ্কগুলোকে ২০২৬১ কোটি টাকা, এই সংস্থাগুলোর প্রতি দেওয়া লোণ বা ঋণ মুছে ফেলতে হয়েছে। অতএব ব্যাংকগুলোও এখন বেছে নিয়েছে মিউতুয়াল ফান্ডে লগ্নি করার পথ। শুনলে অবাক হবেন, গত বছরে ব্যাংকের লগ্নি ছিল মিউচুয়াল ফান্ডে ৬২৪৯৯ কোটি টাকা। এবার মানে, ২০২৪-২৫ এ তা এসে দাঁড়িয়েছে ১.১৯ লক্ষ কোটি টাকায়। মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির পরিমান বেড়েছে ৯১ শতাংশ। যে ব্যাংকগুলোর মুল কাজ ছিল শিল্প ও বাবসায় সঠিক ঋণ প্রদান করে সমগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের। আর তার সঙ্গে সমাজে চাকরির বাজার বাড়ানো, তারাই এখন মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করেছে তাদের টাকা।
শুধু তাই নয় এমনকি প্রয়োজন পড়লে ব্যাংকগুলো তাদের পরিচালিত নয় এমন মিউচুয়াল ফান্ডেও লগ্নি করছে। এর একটা দারুণ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, দুটি ব্যাংকের দুটি মিউচুয়াল ফান্ডের পরিচালন বিভাগ একই সময়ে দুটি মিউচুয়াল ফান্ডের স্কিম চালু করল। অবশ্যই দুজনেই নিজ নিজ সাফল্যের চিত্র তুলে ধরল। অতএব বুঝতেই পারছেন তারা স্কিমটি চালু করার সময় দুজনের “শত্রু” হিসাবেই মিউচুয়াল ফান্ডের ময়দানে হাজির হল। এক বছর পরে হয়ত দেখা গেল, একসময় যে ব্যাঙ্ক এই স্কিমের প্রকারান্তে বিরধিতা করেছিল তারাই সেই ব্যাংকের সেই স্কিমে তাদের ব্যাংকের টাকা লগ্নি করেছে, কারণ ওই ফান্ডে লগ্নি করলে তাদের ব্যাংকের লাভের আশা বেশি। এবার সাধারণ গ্রাহকের অবস্থা বুঝুন। তারা কি করে বুঝবে যে কোন ফান্ডে টাকা রাখলে গ্রাহক বেশি লাভবান হবে। কারন যে সব ব্যাঙ্ক একসময় তাদের স্কিমে টাকা রাখতে বলেছিলেন, তারাই তাদের ব্যাংকের সেই স্কিমে টাকা না রেখে অন্যের স্কিমে টাকা রাখছেন।
কিন্তু এই যে ব্যাংকগুলো বাধ্য হচ্ছে মিচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখতে, শিল্প বাবাবসায়ে ঋণ না দিতে পেরে, তাতে একটা জিনিস বেরিয়ে আসছে যে, যে সব রাজনৈতিক নেতারা দেশের শিল্প বাণিজ্যের দারুণ “সুদিনের” কথা বলছেন তারা আসলে কিসের স্বর্গে বাস করছেন, সেটাই জানতে ইচ্ছা করে। সদ্য প্রকাশিত একটা রিপোর্ট বলছে ভারতীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো চিনের কোম্পানিদের কাছ থেকে ওষুধের যে কাচা মাল কেনে, চিন তার দাম কমাচ্ছে। অতএব আশাকরা যায় আগামী দিনে ওষুধের দামও কমবে। কিন্তু একটা কথা বোঝা যাচ্ছে না যে, “অমৃত কাল”, “বিকশিত ভারত” কথাগুলো প্রতিনিয়ত উচ্চরিত হলেও তার যথার্থতা থাকছে কোথায় ? কাচামালের দাম কমলেও যে ওষুধের দাম সেভাবে কমবে তা বলা যায় কি ? বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কিছুই বলে।