
বাবলু প্রামাণিক, সুন্দরবন : মঙ্গলবার থেকে সুন্দরবনের অরণ্যে শুরু হচ্ছে মৌয়ালদের বার্ষিক মধু সংগ্রহ অভিযান। কুলতলির বিট ফরেস্ট অফিস থেকে বনদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে ৫৫টি দল গভীর জঙ্গলে পাড়ি দিচ্ছে। প্রত্যেক দলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাত জন সদস্য। বনদফতরের তরফ থেকে প্রত্যাশা, এবারের মৌসুমে প্রায় ১০ টন মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।

মৌয়ালরা অর্থাৎ মধু সংগ্রাহকেরা প্রাচীনকাল থেকেই সুন্দরবনের অরণ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু সংগ্রহ করে আসছেন। এ এক দুঃসাহসিক পেশা, যেখানে মৃত্যু প্রতিমুহূর্তে ওঁত পেতে থাকে। বাঘ, কুমির, বিষধর সাপ, প্রতিপদে প্রাণ সংশয়ের মধ্যে দিয়েই এগোতে হয়।

ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ এই তিন মাসই সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সময়ে জঙ্গলের বিভিন্ন গাছে বিশেষ করে হেঁতাল, খলসে প্রভৃতি গাছে ফুল ফোটে এবং মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। তুলনামূলকভাবে এই সময়ে ঝড়বৃষ্টি কম হয়, ফলে মধুর মান ভালো হয় এবং চাকও নষ্ট হয় না।

প্রতি বছর এই সময় মৌয়ালদের প্রস্তুতি শুরু হয়। বনদপ্তরের অনুমতি নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁরা। রওনা হওয়ার আগে স্থানীয় দেবী বনবিবির পুজো দেওয়া হয়। দলে থাকা প্রতিটি সদস্য সঙ্গে রাখেন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। যেমন বড় দা বা ‘হেসো’, ছোট-মাঝারি দা, মোটা দড়ি, খড়, হাড়ি, বালতি, মুখোশ, নেট, গামলা এবং মধু সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিক ও টিনের ড্রাম।

জোয়ার-ভাটা, নদীপথ, জঙ্গলের পথঘাট, সবই মৌলেদের জানা থাকে। কটাল অনুযায়ী তাঁরা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন, যেখানে বিশাল মৌচাক ঝুলছে গাছের ডালে। সাধারণত ১০-১৫ দিনের এই অভিযানে তাঁরা থেকে যান গভীর অরণ্যে, সেখান থেকেই সংগ্রহ করা মধু বনদপ্তরের কাছে তুলে দেন।

এই অভিযানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গ্রামের মহিলাদের এক বিশেষ নিঃশব্দ প্রার্থনা। এই পনেরো দিন তাঁরা উপোস থাকেন, মাছ-মাংস ও শাকসবজি রান্না থেকে বিরত থাকেন। তাঁদের একমাত্র কামনা—স্বামীরা সুস্থভাবে ফিরে আসুন।

এই বছর উৎকৃষ্ট মানের মধুর দাম প্রতি কেজি ২৭৫ টাকা এবং নিম্নমানের মধুর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪০ টাকা। বনদপ্তরের তরফে সংগৃহীত মধু ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট কর্পোরেশন’-এর মাধ্যমে পরিশোধিত ও প্যাকেটজাত হয়ে ‘মৌবন’ নামে বাজারজাত করা হবে। অতিরিক্ত মধু থাকলে বনদপ্তর নিজে থেকেই তা বাজারে বিক্রি করবে।

বলাবাহুল্য, এই যাত্রা শুধু মধু সংগ্রহের অভিযান নয়, বরং এক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য, সাহসিকতা ও জীবন সংগ্রামের প্রতীক। সুন্দরবনের বুকে মৌলেদের এই অনন্য জীবনযুদ্ধ অব্যাহত থাকুক, এটাই সুন্দরবনের জনজীবনের কামনা।
