
সুমন গঙ্গোপাধ্যায়ঃ বিশ বাও জলে বাংলায় তৃণমূল- কংগ্রেস জোট। প্রথমদিকে হাওয়া কিছুটা অনুকূলে থাকলেও দিন যত এগোচ্ছে ততই ভাঙন ধরছে জোটে। প্রায় একাধিকবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন কংগ্রেসের সাথে বাংলায় কোনো জোট নয়। এমনকী ডেরেক রেক ও’ব্রায়েন থেকে কুনাল ঘোষ এই আসন সমঝোতা না হওয়ার পিছনে মূল কারণ হিসাবে টার্গেট করেছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে।
এর মাঝেও একাধিকবার কংগ্রেস হাইকমান্ড কখনো চিঠি লিখে, আবার কখনো ফোনে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে আসন সমঝোতায়ার রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই জয়রাম রমেশ এবং কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খারগে একাধিকবার কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তবে আপাততঃ লাভের লাভ কিছুই হয়নি। অর্থাৎ বাংলায় ৪২ আসনে একাই লড়বে তৃণমূল এখানেই শেষ নয় অধীর রঞ্জন চৌধুরীর গড় বলে পরিচিত বহরমপুরে সর্বশক্তি নিয়ে নামছে তৃণমূল। লক্ষ অধীর চৌধুরীকে পরাজিত করা। এতো গেল ওপরের রাজনীতি। কিন্ত ভিতরের? একটা বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন মনে আছে? – ” ইয়ে আন্দর কি বাত হে…।”
রাজনৈতিক মহলের মতে, এই জোট না হওয়াটা অনেকটা সেই “আন্দর কি বাত।” রীতিমত অঙ্ক কোষেই কংগ্রেসের সাথে বাংলা তে জোট করছেননা মমতা। রাজনৈতিক মহলের ব্যখ্যা, প্রথম থেকে ইন্ডিয়া জোটে থাকার পিছনে বড় কারণ ইতিমধ্যেই নিজেদের সর্বভারতীয় তকমা হারিয়েছে তৃণমূল। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থেকে সর্বভারতীয়স্তরে নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখা।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেবাশিস ঘোষ এর বক্তব্য, ” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ অঙ্ক কষে করেন। এই রাজ্যে কারো সাথে জোট করার প্রয়োজন তৃণমূলের নেই। বিশেষ করে ২ টি আসনের বাইরে তৃণমূলের আসন ছেড়ে কোনো সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্য কোনো রাজ্যে থেকে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা তৃণমূলের নেই, তাও এই রাজ্য থেকে যতো গুলো আসন পাবে, আগামীদিনে দর কষা তে অনেক ভালো জায়গায় থাকবে তৃণমূল।
আর এটাও বাস্তব বিধানসভা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রায় সব ভোটেই মালদহ দক্ষিণ ও বহরমপুর কংগ্রেসের হাতে থাকা এই দুটি লোকসভা আসনের প্রায় ৯৮% বিধানসভা, পৌরসভা এমনকী পঞ্চায়েত পর্যন্ত তৃণমূলের দখলে, সেক্ষেত্রে এই দুই আসন আদৌ কংগ্রেস পাবে কিনা তাই এখন বড় প্রশ্ন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কংগ্রেসকে আসন ছেড়ে নিজের যাত্রাভঙ্গ করার মতো ভুল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করবেন না।” তবে প্রথম থেকে এই দুটি আসন কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবলেও আপাততঃ আর কোনরকম আসন সমঝোতাতেই রাজি নন তৃণমূল সুপ্রিমো।
সূত্রের খবর, প্রথমে ২ টি আসন চাইলেও, পরবর্তীতে বাড়তি আরও ৪ টি আসন চায় কংগ্রেস। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই ৪ টি আসনে কংগ্রেসকে জিততে তৃণমূলের ওপরেই ভরসা করতে হতো, সেক্ষেত্রে কার্যত ‘সংগঠনহীন’ কংগ্রেসকে আসন ছাড়তে নারাজ তৃণমূল। তবে জোট না হলে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা থাকছে। যদিও তা মানতে নারাজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেবাশিস ঘোষ। তাঁর ব্যখ্যা, ” এক্ষেত্রেও অ্যাডভান্টেজে তৃণমূল কারণ গোটা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে আন্দোলন বা বিরোধিতায় থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্ব সঠিক উল্টো পথে চলছে। তারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে যতটা সরব। বিজেপির বিরুদ্ধে ততটা সক্রিয় নয়, স্বাভাবিকভাবেই এই রাজ্যের সংখ্যালঘুরা বিজেপি বিরোধীতায় কংগ্রেসের থেকে তৃণমূলকেই বেশি ভরসা করে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালো করেই জানেন কংগ্রেসের সাথে জোট করার থেকেও বিজেপি বিরোধীতা আরো তীব্র করলে সংখ্যালঘু ভোটের বেশির ভাগই নিজেদের দিকে রাখতে পারবে তৃণমূল।” এর পাশাপাশি আসন সমঝোতা না হওয়ার আরও বড় কারণ ‘ অন্য অঙ্ক ‘। কি সেটা? দেবাশিস ঘোষ এর ব্যখ্যা, ” দেখুন এই মুহূর্তে একাধিক দুর্নীতি নিয়ে রাজনৈতিক ভাবে মারাত্মক চাপে তৃণমূল। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সরাসরি ইন্ডিয়া জোটে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে লড়াই করে এই মুহূর্তে কেন্দ্রের শাসক দলের চক্ষুশুল হতে চাইছে না তৃণমূল।”
রাজনৈতিক মহলের মতে, ভোটের আগে কোন আসন সমঝোতায় না গিয়ে একক শক্তিতে জিতে নির্বাচনের পর হাতে ভালো সংখ্যক সংসদ নিয়ে দর কষাকষির জায়গা আরো মজবুত করতে চাইছে তৃণমূল। বিশেষ করে, নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জায়গায় যদি ইন্ডিয়া জোট আসে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাই নিজেদের শক্তঘাঁটি পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে কোন আসন সমঝোতায় না গিয়ে ‘একলা চলা’র সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ‘এক ঢিলে তিন পাখি’ মারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক, জোটে না গিয়ে হাতে প্রয়োজনীয় সাংসদ সংখ্যা নিয়ে দর কোষাঘষির জায়গায় থাকলেন। দুই, তৃণমূলের শক্তিতে আসন জিতে প্রায় সংগঠনহীন কংগ্রেসকে বলিয়ান হওয়ার সুযোগ দিলেন না। তিন, পাশাপাশি জোট না হওয়ার দায় কংগ্রেসের ঘাড়ে চাপিয়ে কার্যত সিক্সার মারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।