
জয়ন্ত সাহা,আসানসোল : সরকারি জেলা হাসপাতালের পুরুষ জেনারেল ওয়ার্ড। রোগীর নাম বলতেই চমকে তাকালেন সিস্টার ইন চার্জ। উচ্ছ্বসিত হয়ে জানালেন “ওনাকে নিতে এসেছেন ? বাড়ির লোক আপনি ?” উচ্ছ্বাসের কারণ একটাই ওনাদের কেউ নিতে আসেনা। আসানসোল জেলা হাসপাতালে এমন রোগীর সংখ্যা অনেক। যাদের পরিবারের লোকেরা নানান রোগের ছুঁতোয় রোগীকে ভর্তি করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু আর নিতে আসেন নি। হাসপাতালের রেজিস্টারে দেওয়া ঠিকানা এমনকি ফোন নম্বর ভুল। হয়ত আর কখনই এই অসহায় রোগীদের নিয়ে যেতে আসবে না পরিবারের কেউ। আসানসোল জেলা হাসপাতাল যেন বিনা পয়সার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ হয়ে উঠেছে। আর যার ফলে সমস্যায় পড়েছেন জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীদের বেড দখল করে মাসের পর মাস হাসপাতালে পড়ে আছেন এই বৃদ্ধবৃদ্ধারা। যার ফলে অন্য রোগীরাও পরিষেবা থেকে খানিকটা হলেও বঞ্চিত হচ্ছেন বৈকি।
ইস্কো কারখানায় চাকরি করা মহিলা
সুতপা পাল (নাম পরিবর্তিত), প্রাক্তন ইস্কোকর্মী। বয়স প্রায় ৭৫ বছর। এ বছর ২৯ জানুয়ারি, শারিরীক অসুস্থতা দেখিয়ে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। তারপর আর কেউ আসেনি ওকে নিয়ে যেতে। এখন মহিলা জেনারেল ওয়ার্ডের বেডে বসে বিড়বিড় করে বলে চলেন মহিলা। “নিশ্চয় আজ কেউ আসবে”। কিন্তু কেউ আসেন না।
আরেক রুগী সুতপা দেবী, তিনি জানালেন “আমার আসল বাড়ি ছিল বাংলাদেশে। পরে হীরাপুরের রাধানগর রোডে নিচু পাড়ায় থাকতাম। এই শহরে আসা চাকরির সূত্রে। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে ইস্কোতে চাকরি পেয়েছিলাম। অনেকদিন চাকরি করেছি”। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, মেয়ের পরিচয় দিয়ে এক মহিলা তাঁকে ভর্তি করে গিয়েছিলেন। আর আসেননি খোঁজ নিতে। এত মাস আসানসোল জেলা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছেন সুতপা দেবী। কবে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাবে তার মেয়ে। তিনি জানালেন “মেয়ের শরীর খারাপ, তাই হয়ত আসতে পারছে না, আসবে ঠিক। ফোনও নেই। তাই কথা বলতে পারছি না”।
না কাউকে দোষ দেন নি সুতপা দেবী। বরঙ মেয়ের নিয়েই উৎকন্ঠা তাঁর। পালটা প্রশ্ন করলেন “সবাই ঠিক আছে তো”। আর যাই হোক মায়ের মন তো !

বছর পঞ্চাশের প্রণব ঘোষ (নাম পরিবর্তিত)। একসময় বাড়ি ছিল বীরভুমে। তারপর চলে আসেন চিত্তরঞ্জনে। দাদার বাড়িতেই ছিলেন। চাকরি করতেন চিত্তরঞ্জন লোকোমেটিভ ওয়ার্কসে। কিন্তু বেশী দিন নাকি চাকরি করতে পারেন নি। বিয়ে করেননি। দাদা আর ভাইপো তাঁকে মাথা ব্যথা হয় এমন কারণ দেখিয়ে আসানসোল জেলা হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে গেছেন। অনেক দিন হল তিনি সুস্থ হয়ে খাটে শুয়ে আছেন। কিন্তু কেউ নিতে আসেননি। প্রণব ঘোষের বিশ্বাস ভাইপো আসবে নিতে। কিন্তু কবে ? খোঁজ নিতে এসেছে কি ? প্রণব বাবুর শুকনো গলায় প্রণববাবু জানালেন, “না, আর আসেনি”।
এঁদের নিতে কারুর কেউ আসছেন না
কাছে যেতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বিকাশ সুত্রধর (নাম পরিবর্তিত)। “আমাকে কেউ নিতে আসছে না। এখানে পড়ে আছি”।
হ্যাঁ, বাড়ি ফিরতে চান বিকাশ সূত্রধর। কিন্তু পরিবারের সাড়া পাননি ষাঠোর্দ্ধ এই প্রবীন। আসানসোল জেলা হাসপাতালের পুরুষ সাধারণ বিভাগে ভর্তি তিনি।
সূত্রধর বাবু জানালেন, “আমার বাড়ি ছিল বারাবনীর পাঁচগাছিয়ায়। বাড়িতে দাদা, বৌদি, ভাইপোরা আছে। আমি একটি দোকানে কাজ করতাম। এখানে আমাকে অসুস্থ বলে ভর্তি করে গেছে। কেউ নিতে আসছে না আর”। আসানসোল জেলা হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স জানালেন, “আপনাদের খবরে যদি ওনার চোখের জল দেখে পরিবারের মানবিকতা ফেরে” !
রয়েছেন এমন অনেক রোগী ( সবার নাম পরিবর্তিত)
আসানসোল মহিশীলা কলোনীর গীতা দেবী। ভর্তি করে গিয়েছিলেন পরিবারের লোকেরা। সুস্থ হওয়ার পর খোঁজ নিতেও আসেনি আর কেউ। আসানসোলের বিন্দু বাউরির অপারেশন হয়েছে হাড়ের। পড়ে গিয়েছিলেন। এখন সুস্থ। পরিবারের লোকেরা প্রথম প্রথম এলেও, এখন আর খোঁজ নেই। ফোনেও পাওয়া যায়না। গত ২৬ মার্চ থেকে দুটি পা কাটা অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অজ্ঞাত পরিচয় এক মহিলা। বাড়ির ঠিকানাও বলতে পারছেন না তিনি। নার্সদের কাছে জানা গেল, সম্ভবত রেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন ওই মহিলা।

আসানসোল চেলিডাঙার বাসিন্দা আশা গুপ্তকে সামান্য পেট খারাপ নিয়ে গত কুড়ি এপ্রিল ভর্তি করে দিয়ে গেছে বাড়ির লোক। আর কেউ আসেননি খোঁজ নিতে। আসানসোল গ্রামের নামোপাড়া ছোট বটতলা এলাকার প্রবীন কৃষ্ণ লাল। প্রতিবেশী এক যুবক ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের লোক কখনই আসেননি আর। মাসের পর মাস এভাবেই বহু রোগী আসানসোল জেলা হাসপাতালে রয়ে গেছেন। যাদের পরিবারের লোকজনেরা আসেনা, খোঁজ নেয়না।
মানবিক নার্স
বয়স জনিত কারণে অনেকে এমন আছেন, যাদের বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাও নেই। ফলে উঠে টয়লেট যাওয়ারও শক্তিও নেই অনেকের৷ বিছানাতেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেলেন। যেহেতু তাদের কাছে টাকা পয়সাও নেই। তাই আয়া রাখার প্রশ্ন ওঠে না। সমস্যায় পড়েন নার্সরা।
আসানসোল জেলা হাসপাতালের এক সিনিয়র নার্স তাপসী প্রামানিক জানালেন, “অনেক বৃদ্ধ শরীরে জোর নেই৷ তাদের স্নান করানো, কাপড় জামা পরানো সব আমরা নার্সরা করি। নার্সরাই নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে তাদের পোশাকের ব্যবস্থা করেন। কী করব উপায় নেই ! চোখের সামনে মানুষগুলোর কষ্ট দেখেঅমানবিক হতে পারব না”।

সমস্যায় আসানসোল জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
এই যে এত এত রোগী এভাবে আসানসোল জেলা হাসপাতালের বেড দখল করে পড়ে আছেন, তাতে বিরাট সমস্যায় পড়েছেন আসানসোল জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীদের বের করেও দিতে পারেন না তাঁরা। আবার বেড দখল করে পড়ে থাকার জন্য অন্য রোগীকে সেই বেড দেওয়াও যায়না। আসানসোল জেলা হাসপাতালের সুপার নিখিল চন্দ্র দাস জানান, “এই সমস্যা বলে বোঝানো যাবেনা। পরিবার ছেড়ে দিয়ে গেছে এমন রোগী যেমন আছে, কিছু ভবঘুরে রোগীও আছে। যারা আবার বেডে থাকে না। ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ পালায়। তখন আবার পুলিশের দ্বারস্থ হতে হয়। পরিবারের যারা ছেড়ে গেছেন, তারা আবার নিতে ফিরে আসবেন কি না সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। ফলে তাদের সরকারি হোম বা অন্যত্র পাঠাতে পারি না। যদি পরিবারের লোকের ফিরে এসে উলটো চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে হোমে পাঠানোর যে নিয়ম প্রক্রিয়া থাকে তা মেলে না। ফলে রোগীরা বেড দখল করেই পড়ে আছে। ওই বেডে অন্য রোগীকে পরিষেবা দেওয়া যেত। সেটা আমরা করতে পারছি না।”