
তাপস মহাপাত্র : ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বশক্তির তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। হোয়াইট হাউসে আমেরিকা ও ইউক্রেন দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বাদানুবাদ ঘিরে এখনই ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে বিভাজনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবহারে অপমানিত ন্যাটো ভুক্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলির একাংশ বলতে শুরু করেছে ‘মুক্ত বিশ্বে’ ঠাঁই নেই আমেরিকার। শুরু হয়েছে নতুন নেতার খোঁজ। ইউক্রেন ইস্যুতে আমেরিকার শান্তি প্রক্রিয়া ভেস্তে যাবার পর এই প্রথম শোনা গেল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের উচ্চারণ।
ওভালে ট্রাম্প ও জেলেনেস্কির আলোচনা চলাকালীন সংবাদমাধ্যমের সামনেই পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধের জন্য ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকেই দায়ী করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর সাফ কথা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়ায় বসেছেন জেলেনস্কি। ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের অনড় আচরণে একদিকে যেমন রাগে ফুঁসছে আমেরিকা, তেমনি এই নিস্ফলা বৈঠকের পর বাঁক নিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। বদলাতে শুরু করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকা ইউরোপের সম্পর্কও। ফলে উঁকি দিচ্ছে নতুন সমীকরণ।
২৮ ফেব্রুয়ারি ওভালে ট্রাম্প-জেলেনস্কির টানা ৪০ মিনিটের বাদানুবাদ দেখলো গোটা দুনিয়া। হোয়াইট হাউস ছেড়ে যে ভাবে বেরিয়ে গেলেন জেলেনস্কি, তাতে কোনো ইতিবাচক ভবিষ্যতের ইংগিত ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে কোথাও যেন মেঘ ঘনাচ্ছে। এরপরেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ও বিদেশনীতির প্রধান কাজা কালাসের মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘‘ মুক্ত বিশ্ব তৈরি করার জন্য নতুন নেতার প্রয়োজন।“ এরজন্য তিনি ইউরোপীয় দেশগুলিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ইউক্রেন হল ইউরোপ। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে তাই তাঁদের উচিত কিভকে সমর্থন করা।
এক্স হ্যান্ডলে করা এই পোস্টে কালাস অবশ্য কে হবেন ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা, কী ভাবে তা ঠিক হবে, এসব নিয়ে খোলসা করে কিছু জানাননি। তবে এ ব্যাপারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি-সহ পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। এরমধ্যেই ইউক্রেন যাতে অস্ত্র কিনতে পারে তার জন্য আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ পদাধিকারীর এই মন্তব্যে অবশ্য দুর্যোগের সম্ভাবনা দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরা মনে করছেন, ওভালের ঘটনায় জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। ফলে আমেরিকা যদি ন্যাটো ত্যাগ করে তাহলে ইউরোপের নিরাপত্তার সমীকরণটা কী দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল !
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার উদ্যোগেই মূলত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন বা নেটো) গড়ে ওঠে। ইউরোপের ৩২টি দেশ এর সদস্য। যাদের মধ্যে অন্যতম অঙ্গীকার হল পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা। এরপর প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চলে ‘স্নায়ু যুদ্ধ’। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে এই ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে। এর পর থেকেই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রবল ভাবে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ইউরোপের দেশগুলি। কিন্তু এই সমীকরণ বদলে যায় ট্রাম্পের দ্বিতীয় জমানায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয়বার শপথ নিয়ে চলতি নীতি বদলে দিয়েছেন ট্রাম্প। ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ফি বছর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে রাজি নন তিনি। প্রয়োজনে নেটো ত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন। তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর। এই আচরণ দেখে আমেরিকার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে নিজেদের তৈরি করছে ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো শক্তিধর দেশগুলি। তাই কি দেখা দিয়েছে ‘মুক্ত বিশ্ব” বা “থার্ড ব্লক”-এর সম্ভাবনা ? বিশ্ব রাজনীতির সজাগ দৃষ্টি এখন এইদিকে।
আগামী জুন মাসে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের সদর দফতরে নেটোভুক্ত দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলন। জার্মান চ্যান্সেলর মেয়ার্ৎজ় জানিয়েছেন, ‘‘জুনের সম্মেলনেই নেটোর রূপ বদলের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।” তবুও এই লক্ষ্যে ন্যোটোর সব সদস্য সম্মতি জানাবে কিনা তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এখনই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদে প্রবল আপত্তি রয়েছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমান্যুয়েল মাকরঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের। এ কথা খোলাখুলি ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন তাঁরা। ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও ইউরোপ, ইউক্রেন এবং আমেরিকার মধ্যে একটি জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তবে ইটালির প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ট্রাম্প মেনে নেবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্য দিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান আবার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার জন্য জ়েলেনস্কিকেই দুষেছেন।
তবে ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্ব রাজনীতিকে ঘিরে যে বাদানুবাদ, যে নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে তা কি শুধুমাত্র ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ, গতিপ্রকৃতি তা বলে না। পশ্চিমের আধিপত্য স্থাপন এবং পূর্বের, বস্তুত রাশিয়ার অস্তিত্ত্ব ও সার্বভৌমত্ত্বের স্বপ্ন কোন দুর্যোগের সৃষ্টি করে সেদিকেই তাকিয়ে বিশ্বে রাজনীতি। কারণ, বিশ্ব শক্তিতে “থার্ড ব্লক” বা মুক্ত বিশ্ব গঠনের তোড়জোড় কোন দিকে যায় তার উপর নির্ভর করছে বিশ্ব পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ।