
স্পোর্টস ডেস্ক : মঙ্গলবার জলপাইগুড়িতে উদ্বোধন হতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল সরণি I জলপাইগুড়ি মিউনিসিপ্যালিটির আধিকারিকরা “থানা মোড় থেকে বাবুপাড়ার স্বর্গীয় দাজু সেনের বাড়ি পর্যন্ত” রাস্তাটি “ইস্টবেঙ্গল সরণি” হিসেবে নির্ধারিত করেছেন l
মঙ্গলবার দুপুর ৩ টায় এই “ইস্টবেঙ্গল সরণি” র উদ্বোধন হবে l ক্লাব কর্মকর্তারা ছাড়াও উপস্থিত থাকছেন লাল হলুদের প্রাক্তন ফুটবলাররা l উপস্থিত থাকবেন জলপাইগুড়ি শহরের অগণিত লাল হলুদ সভ্য-সমর্থক I
এই “ইস্টবেঙ্গল সরণির” ঠিক পাশের রাস্তায় বাড়ি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কিংবদন্তি গোলরক্ষক মনিলাল ঘটকেরI ১৯৪৯-৫৪, ইস্টবেঙ্গল দুর্গের শেষ প্রহরী ছিলেন মনিলাল ঘটক। জলপাইগুড়ি টাউনের বিখ্যাত উকিল দুর্গাপ্রসন্ন ঘটকের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন মনিলাল। পঞ্চ-পাণ্ডবের সেই সময়কালে স্বর্ণালী ইস্টবেঙ্গলে গোলরক্ষককে একটি আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন মনিলাল। দেশ ছাড়িয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তখন ইস্টবেঙ্গলের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ২০১০ সালে মনিলাল ঘটককে জীবনকৃতি সম্মানে সম্মানিত করে।
জলপাইগুড়ি তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গ হলো ইস্টবেঙ্গলের দ্বিতীয় ঘর I সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে লাল হলুদের লক্ষ লক্ষ সমর্থক। ১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠার সময়কালে যেমন পদ্মা পাড়ের বহু মানুষ কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে থাকতেন, সেরকমই হাজার হাজার পদ্মা পাড়ের মানুষের ঠিকানা ছিল সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে জেলা গুলোতে। ‘৪৭ এর দেশ বিভাগে সেই সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যায়। আবার ‘৭১ এর যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নিরন্ন, অসহায়, ছিন্নমূল মানুষেরা দক্ষিণবঙ্গের মতো উত্তরবঙ্গেও মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেয়। দু দুটি দেশভাগে সব কিছু হারানো মানুষদের আশা-ভরসা হয়ে ওঠে এই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। ক্লাবের একটি জয়ে দু দিনের না খেতে পাওয়া মানুষগুলো অনায়াসে তাদের কষ্ট ভুলে যেতে পারতেন। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক হঠাৎ করে কেউ হয় না, বংশ পরম্পরায় লাল হলুদ রক্ত তাদের শরীরে ধাবিত হয়। তাই বংশ পরম্পরায় সমগ্র উত্তবঙ্গ জুড়ে প্রবীণদের মতো নবীন প্রজন্ম আজও সমান ভাবে লাল হলুদের দীপ্ত মশালকে স্বগৌরবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
জলপাইগুড়ি তথা সমগ্র উত্তরবঙ্গের সাথে ইস্টবেঙ্গলের যে এই নিবিড় যোগ – তার কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি –
১৯২০ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠার পিছনে শৈলেশ বসুর একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। ১৯২৪ সালে তিনি ব্যবসায়িক কাজে দিনাজপুর চলে যান আর সেখানে দিনাজপুর ক্লাবে ক্রিকেট খেলাও চালু করেন। শৈলেশ বসু এর পাশাপাশি কোচবিহার মহারাজার ক্রিকেট দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। চার বছর দিনাজপুরে কাটিয়ে ১৯২৮ সালের শেষের দিকে তিনি ঢাকার মালখাননগর ফিরে আসেন।
১৯২৫ সালে কলকাতা ফুটবল লীগের প্রথম সাক্ষাতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ১-০ গোলে পরাজিত করে মোহনবাগানকে। ওই ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেছিলেন প্রখ্যাত ফরওয়ার্ড নেপাল চক্রবর্তী। তিনি তাঁর শেষ জীবনটা কাটিয়েছিলেন জলপাইগুড়ি শহরে। ১৯৬৭-৭৩, পরিবার নিয়ে তাঁর ঠিকানা ছিল জলপাইগুড়ি পুলিশ কোয়ার্টারের পাশের সরকারি আবাসন।
১৯২০ সালে জলপাইগুড়ি শহরে জন্ম মোজাম্মেল হকের। ১৫ বছর বয়সে জলপাইগুড়ির পল ওয়েন স্কুলের হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন। কিছুদিন খেলেছিলেন বেঙ্গল ডুয়ার্স রেল (বি.ডি.আর.) দলের হয়েও। ১৯৩৮ সালে জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবে যোগ দিলেন। ১৯৩৮ সালেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে এলো জলপাইগুড়িতে। টাউন ক্লাবের সাথে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সেই খেলায় মোজাম্মেল হক টাউন ক্লাবের হয়ে ডিফেন্স অসাধারণ ফুটবল খেলেন। সেদিন একটি ১৯ বছরের ছেলের দুরন্ত রক্ষণের জন্যই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গোলের মুখ খুলতে পারে নি। তার খেলা দেখে তৎক্ষণাৎ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের খ্যাতনামা ফরওয়ার্ড দুলাল গুহ ঠাকুরতা, তাকে একপ্রকার জোর করেই কলকাতা নিয়ে আসেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১, এই তিন বছর মোজাম্মেল হক ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। পরবর্তীতে আবার ফিরে আসেন জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাব। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবের হয়েই ফুটবল খেলে, অবশেষে খেলা থেকে অবসর নেন মোজাম্মেল হক।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ২০১৯ এ ক্লাবের শতবর্ষের মঞ্চে “শতাব্দীর সেরা কোচের” সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন কিংবদন্তি প্রশিক্ষক পি.কে.ব্যানার্জিকে। গত ১০৩ বছরে ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি ট্রফি জয়ের কৃতিত্ব পি.কে.ব্যানার্জির। সেই কিংবদন্তি প্রশিক্ষকের জন্ম ২৩ জুন, ১৯৩৬ সালে জলপাইগুড়িতে। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকেই তিনি তাঁর প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে জলপাইগুড়িতে জন্ম আরেক প্রখ্যাত ফরওয়ার্ড সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদারের। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়াশুনার পাশাপাশি জলপাইগুড়ি ইয়ং মেনস এসোসিয়েশন এবং জলপাইগুড়ি টাউন ক্লাবে তাঁর ফুটবল খেলা শুরু। ১৯৭৫ এ খেলেছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে।
প্রখ্যাত প্রাক্তন ক্রিকেটার মন্টু সান্যাল ও এই জলপাইগুড়ি শহরের বাসিন্দা I
অতীতের মতো বর্তমানেও বহু খেলোয়াড় উত্তরবঙ্গ থেকে উঠে আসছে এবং ইস্টবেঙ্গল তথা ভারতের বিভিন্ন টিমে কৃতিত্বের সাথে খেলছে। যাদের মধ্যে মনোজ মহম্মদ, সমীক মিত্র, সুজিত সিংহ, রূপম রায় উল্লেখযোগ্য I বর্তমানে ইস্টবেঙ্গলের অনুর্দ্ধ ১৭ টিমে যারা কৃতিত্বের সাথে খেলছে, সেই দেবোজিত রায় প্রজ্জল সাহা, আশীষ রায় ও জলপাইগুড়ির বাসিন্দাI
সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে নতুন প্রতিভা তুলে আনতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব দীর্ঘদিন ধরে সাফল্যের সাথে পরিচালনা করছে রাজগঞ্জ ইস্টবেঙ্গল ওয়েলফেয়ার ফুটবল একাডেমি। প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের থাকার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তাঁর জন্য তৈরী করেছে “পল্টু দাস ভবন”।