
ওঙ্কার ডেস্ক : সিকিমের ৫০-তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে নাগরিকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানটির থিম ছিল ‘উন্নয়ন যেখানে উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলিত হয় এবং প্রকৃতি যে উন্নয়নকে লালিত করে’। খারাপ আবহাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সিকিম সফর বাতিল হয়। তার জন্য তিনি আক্ষেপও করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হল না। অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যবাসীর সাফল্য প্রত্যক্ষ করতে তিনি সিকিম সফর করবেন বলে জানিয়েছেন। মোদী বলেন, “৫০ বছর আগে সিকিম নিজেই গণতন্ত্রের যাত্রাপথে চলা শুরু করে। সিকিমের মানুষ ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে সেদিন শুধু যুক্তই হননি, তাঁরা তাঁদের আত্মাকেও এর সঙ্গে যুক্ত করেন।”
তিনি বলেছেন, “সিকিম দেশের গর্ব”। গত ৫০ বছর ধরে এই রাজ্য প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে যে উন্নয়ন বাস্তবায়িত করেছে, তা আদর্শ হয়ে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই রাজ্য ১০০ শতাংশ জৈব রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে মাথা পিছু আয় সিকিমে সব থেকে বেশি। মোদী বলেন, “এই সাফল্যের মাধ্যমে রাজ্যের মানুষের ক্ষমতা প্রতিফলিত হয়”। রাজ্যগুলির প্রতি তাঁর সরকার কী মনোভাব পোষণ করে তা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভারতের প্রতিটি রাজ্য এবং অঞ্চলের স্বতন্ত্র শক্তি রয়েছে। এই বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার গত এক দশকে উত্তর পূর্বাঞ্চলকে উন্নয়নের কেন্দ্রে রেখে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করেছে। সরকার ‘অ্যাক্ট ফাস্ট’ ভাবানায় ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিকে বাস্তবায়িত করছে।”
দিল্লিতে সদ্য অনুষ্ঠিত উত্তর পূর্বের বিনিয়োগ সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলনে প্রথম সারির বিনিয়োগকারী এবং শিল্পপতিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সিকিম সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন। আগামীদিনে সিকিম এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের যুব সম্প্রদায়ের জন্য বিপুল কাজের সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
সিকিম সহ সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলে ভারতের উন্নয়ন যাত্রার নতুন এক অধ্যায় রচিত হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দিল্লি দূরে হওয়ার কারণে অতীতে এখানে উন্নয়ন যথাযথভাবে হয়নি। এই অঞ্চল এখন নতুন নতুন সম্ভাবনার সুযোগ নিয়ে এসেছে। এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হল এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বর্তমানে উন্নত হচ্ছে। আগে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং কর্মসংস্থান যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের ছিল। তবে গত এক দশকে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এই সময়কালে সিকিমে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার নতুন মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। গ্রামগুলিতে নতুন নতুন সড়ক নির্মিত হয়েছে। অটল সেতু নির্মাণের ফলে সিকিমের সঙ্গে দার্জিলিং-এর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এই রাজ্যের সঙ্গে কালিম্পং-এর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দ্রুত গতিতে কাজ হচ্ছে। বাগডোগরা-গ্যাংটক এক্সপ্রেসওয়ে ভবিষ্যতে সিকিমে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে আরও সুবিধা করে দেবে। এই মহাসড়ককে গোরক্ষপুর-শিলিগুড়ি এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পরিকাঠামো শক্তিশালী করা হবে বলে জানান মোদী।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যের রাজধানী শহরের সঙ্গে রেল পরিষেবা শুরু করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেই কাজ দ্রুত গতিতে চলছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান। সেবকের সঙ্গে রঙপোর মধ্যে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্বোধন হলে তা জাতীয় স্তরে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যুক্ত করবে। যেখানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না, সেইসব অঞ্চলে বিকল্প হিসেবে রোপওয়ে গড়ে তুলতে হবে। এই অনুষ্ঠানে তিনি রাজ্যে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। এর ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষরা উন্নতমানের চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
“কৃষি বিপ্লবের নতুন ধারায় সিকিম নেতৃত্ব দিচ্ছে।” বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। সিকিম থেকে জৈব পদ্ধতিতে কৃষি কাজে উৎপাদিত ফসল রপ্তানির হার ক্রমশ বাড়ছে। সম্প্রতি সিকিমের বিখ্যাত ডাল্লে খুরসানি লঙ্কা রপ্তানি হয়েছে। রাজ্য থেকে উৎপাদিত আরও বহু ফসল ভবিষ্যতে রপ্তানি হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সিকিম সরকারকে এই উদ্যোগগুলি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। সিকিমের জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের উদ্যোগকে আরও উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় সরকার সোরেং জেলায় প্রথম জৈব পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ প্রকল্প গড়ে তুলবে- দেশের মধ্যে যা প্রথম।
সম্প্রতি দিল্লিতে নীতি আয়োগের পরিচালন পরিষদের বৈঠকে প্রতিটি রাজ্যের একটি পর্যটন কেন্দ্রকে বিশেষভাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিকিমের পরিচয় শুধু একটি পার্বত্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই নয়, এটিকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মোদী বলেন, “সিকিমের সম্ভাবনা অপরিসীম, এই রাজ্যের জন্য একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজের প্রয়োজন।” প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, “অ্যাডভেঞ্চার এবং স্পোর্টস ট্যুরিজমে সিকিমের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।” ট্রেকিং, মাউন্টেন বাইকিং এবং উঁচু জায়গায় নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সম্মেলন, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জলসা সংক্রান্ত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এই রাজ্যকে গড়ে তোলা যায়। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এখানে গোল্ডেন জুবিলি কনভেনশন গড়ে তোলা হবে, যে কেন্দ্রে বিশ্বের প্রথিতযশা শিল্পীরা আসবেন বলে জানান মোদী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমন দিন আর দূরে নেই যেদিন সিকিমের প্রত্যেক গ্রাম এবং শহর থেকে একজন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদের উত্থান হবে। “খেলাধুলা শুধুমাত্র অংশ নেওয়ার কর্মসূচি নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে জয়লাভ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।” গ্যাংটকে নতুন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শ্রী মোদী বলেন, এই কেন্দ্র ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়নদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। খেলো ইন্ডিয়া প্রকল্পের আওতায় এই রাজ্য বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
পাহেলগাম-এ সম্প্রতি জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই হামলা শুধু ভারতবাসীদের ওপর হামলা নয়, এটি মানব জাতির ওপর হামলা, ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর হামলা। জঙ্গিরা শুধু বহু পরিবারের আনন্দকেই কেড়ে নেয়নি, তারা ভারতবীসার মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চালিয়েছে। “আজ ভারতের অপ্রতিরোধ্য একতা সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। দেশ এক যোগে জঙ্গিদের এবং তাদের মদতদাতাদের পরিস্কার একটি বার্তা পাঠিয়েছে।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতীয় মহিলাদের কপালের সিঁদুর মুছে দিয়ে তারা যে যন্ত্রণা দিয়েছে, ভারত তার জবাব অপারেশন সিঁদুরের মাধ্যমে দিয়েছে। জঙ্গি ঘাঁটিগুলিকে ভারত ধ্বংস করে দেওয়ার পর পাকিস্তান ভারতের সাধারণ নাগরিক এবং সৈন্যদের ওপর হামলা চালানো শুরু করে। এর ফলে পাকিস্তানের আসল রূপ প্রকাশিত হয়েছে। ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের কৌশলগত দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সিকিমের ৫০ বছরের সাফল্য সকলের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। এই রাজ্যে উন্নয়ন যাত্রা ভবিষ্যতে আরও ত্বরাণ্বিত হবে। স্থানীয় চাহিদার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণের জন্য সিকিমের তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।” সিকিমকে আগামী ২৫ বছরে উন্নয়নের নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য সকলকে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।