
স্পোর্টস ডেস্ক :দশ জনে খেলেও এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল এফসি। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোল অক্ষত রাখতে পারেনি তারা। ম্যাচের একেবারে শেষ দিকে ন’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল করে জয় নিশ্চিত করে ফেলে তুর্কমেনিস্তানের এফকে আর্কাদাগ এবং টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে জায়গা সুনিশ্চিত করে ফেলে।
এ দিন দু’গোলে জেতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে তুর্কমেনিস্তানের অচেনা পরিবেশে খেলতে নেমে প্রথম মিনিটেই মেসি বৌলির গোলে এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। তার পর থেকে হোম টিমের লাগাতার আক্রমণ একের পর এক আক্রমণ রোখার পাশাপাশি তারাও পাল্টা আক্রমণে উঠতে শুরু করে এবং একাধিক গোলের সুযোগও তৈরি করে কলকাতার দল। কিন্তু কোনওটি থেকেই দ্বিতীয় গোল করতে পারেনি। বারবার ব্যর্থতার মাশুল দিতে হয় তাদের।
কিন্তু ম্যাচের ৩২ মিনিটের মাথায় লাল কার্ড দেখেন ডিফেন্ডার লালচুঙনুঙ্গা। ফলে ম্যাচের বাকি প্রায় ৭০ মিনিট (সংযুক্ত সময়-সহ) দশ জনে খেলতে হয় মশাল-বাহিনীকে। তা সত্ত্বেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে তারা। দুরন্ত গতি, দুর্দান্ত ট্রানজিশন, লড়াকু মানসিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা- এ সবই তাদের খেলায় দেখা গেলেও গোলের জন্য নিখুঁত শট বা হেড দেখা যায়নি। ৭৫ মিনিট পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে একটিও শট গোলে রাখতে দেয়নি তারা। মনেই হচ্ছিল না খেলাটা দশ বনাম এগারোর হচ্ছে।
কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার মিনিট তিনেক আগে যে ভুল করে বসেন মিডফিল্ডার শৌভিক চক্রবর্তী, এত লড়াইয়ের পর তারই মাশুল দিতে হয় ইস্টবেঙ্গলকে এবং সেই ভুল কাজে লাগিয়ে পেনাল্টি থেকে সমতা আনেন আর্কাদাগের পরিবর্ত ফরোয়ার্ড আলতিমিরাত আনাদুর্দিয়েভ, যা তাদের সেমিফাইনালে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
হতোদ্যম ইস্টবেঙ্গল খেলোয়াড়রা এক সংযুক্ত সময়ের একেবারে শেষ দিকে ফের গোল খায় এবং এ বারেও সেই সুপার সাব আনাদুর্দিয়েভ প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে এই প্রথম এএফসি-র টুর্নামেন্টে খেলে তার সেমিফাইনালে জায়গা সুনিশ্চিত করে নেয়। কলকাতায় এক গোলে জয় ও এ দিনের ২-১ জয়ের ফলে ইস্টবেঙ্গলকে ছিটকে দিয়ে শেষ চারে উঠে পড়ে তারা।
এ দিন প্রথম মিনিটেই রাফায়েল মেসি বৌলির গোলে এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল এফসি। শুরুর দিকে যে গোল দিতে হবে তাদের, তা কোচ অস্কার ব্রুজোন ম্যাচের আগের দিনই বলেছিলেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়িই যে গোল পেয়ে যাবে তার দল, তা বোধহয় ভাবতে পারেননি।
নিজেদের অর্ধ থেকে নেওয়া ফ্রিকিক মাথা দিয়ে নামিয়ে দিমিত্রিয়স দিয়ামান্তাকসের দিকে ঠেলেন মেসি বৌলি। গ্রিক ফরোয়ার্ড আবার বল ফেরৎ পাঠান ক্যামেরুনের ফরোয়ার্ডের কাছে। ততক্ষণে গোলের আরও সামনে পৌঁছে যান মেসি বৌলি। বিন্দুমাত্র ভুল না করে ছোট্ট এক টোকায় বল গোলে পাঠিয়ে দেন তিনি (১-০)।
প্রতিপক্ষের মাঠে নেমে শুরুতেই গোল পাওয়ার পর যে তাদের দিকে কী ধেয়ে আসতে চলেছে, তা বুঝে নিয়েই নিজেদের রক্ষণ আঁটোসাঁটো করে নেন লাল-হলুদ ফুটবলাররা। আর্কাদাগের ঘনঘন আক্রমণ সামলাতে প্রায় পুরো দলই নীচে নেমে আসে এবং সেই সুযোগে কাউন্টার অ্যাটাকেও উঠতে শুরু করেন মেসি বৌলিরা।
এমনই এক কাউন্টার অ্যাটাকে ব্যবধান বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পান দিয়ামান্তাকস ও রিচার্ড সেলিস। ১৭ মিনিটের মাথায় মাঝ বরাবর উঠে দিয়ামান্তাকস গোলের উদ্দেশ্যে শট নেন। কিন্তু তা পোস্টে লেগে ফিরে আসে। ফিরতি বলে সঠিক শট নিলে অবধারিত গোল পেতেন সেলিস। কিন্তু তাঁর শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায় মরিয়া ইস্টবেঙ্গল এবং ম্যাচের ২৮ মিনিটের মাথায় ফের সুযোগ পান মেসি বৌলি। এ বার সল ক্রেসপোর ক্রস থেকে গোলে দু-দু’বার শট নেন তিনি। প্রথমবার ব্লক হওয়ার পর দ্বিতীয়বার গোললাইন সেভ হয়। প্রতিপক্ষের রক্ষণকে এ দিন বেশ ব্যস্ত রেখেছিলেন দুই লাল-হলুদ সেন্টার ফরোয়ার্ড।
কিন্তু ৩২ মিনিটের মাথায় যে ধাক্কা খায় কলকাতার দল, তা সামলানো বেশ কঠিন ছিল। আর্কাদাগের গোলমুখী মিডফিল্ডার ইয়াজগিলিচ গুরবানভকে বক্সের ঠিক সামনে বাধা দেওয়ায় দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখতে হয় লেফট ব্যাক লালচুঙনুঙ্গাকে। ১১ মিনিটের মাথায় তিনি প্রথম হলুদ কার্ড দেখেছিলেন নিজেদের বক্সের সামনেই ফাউল করে। সেই ভুল তিনি ফের করে মাঠ ছাড়েন। তবে ফ্রি কিক-কে কাজে লাগাতে পারেনি আর্কাদাগ।
এর পর থেকে দশ জনে খেললেও ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে ফাটল ধরাতে পারেনি ‘হোম টিম’। হেক্টর ইউস্তে, জিকসন সিং, মহম্মদ রকিপরা তো সব সময় সতর্ক ও মরিয়া ছিলেনই। মাঝামাঠ থেকে ক্রেসপো, মহেশ, শৌভিকরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিলেন এবং প্রয়োজনে আক্রমণেও সহায়তা করেন তাঁরা।
প্রথমার্ধে ৬৫ শতাংশ বল নিজেদের দখলে রাখলেও একটিও শট গোলে রাখতে পারেনি আর্কাদাগ। সেখানে ইস্টবেঙ্গল তিন-তিনটি শট গোলে রাখে। এই পরিসংখ্যানেই আন্দাজ পাওয়া যায়, কতটা উজ্জীবিত ফুটবল খেলে তারা।
দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবধান বাড়িয়ে ও গোল অক্ষত রেখে সেমিফাইনালে ওঠাই ছিল ইস্টবেঙ্গলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সে জন্য দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ ব্যাকে খেলা শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। সামনে ছিলেন যথারীতি তিনজন। শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিল আর্কাদাগ। পাল্টা ইস্টবেঙ্গলও সুযোগ তৈরি করার চেষ্টা করে এবং আক্রমণে ওঠা মেসিকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আক্রমণ করে তারা। তাতেও দমে যাননি তিনি। ফের আক্রমণ হানে মশাল-বাহিনী এবং ৫২ মিনিটের মাথায় দিয়ামান্তাকসের ক্রস থেকে হেডে গোল করার সুযোগ পান সেলিস। কিন্তু এ বারও ব্যর্থ হন তিনি।
মিনিট দশেকের মধ্যে এরিয়াল বলের দখল নিতে গিয়ে চোট পান দিয়ামান্তাকসও। তবে তিনি খেলা চালিয়ে যান। তারা যে দশজনে খেলছে, এক মুহূর্তের জন্যও তা বুঝতে দিতে চাননি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা। নিজেরাও সম্ভবত তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় তারা। যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই লাল-হলুদ জার্সির ভীড় দেখা যায় সারাক্ষণ।
ম্যাচের ৭৪ মিনিট পর্যন্ত একটিও শট গোলে রাখতে না পারা আর্কাদাগ ৭৫ মিনিটের মাথায় প্রথম শট গোলে রাখে ফ্রি কিক থেকে, যা নেন তাদের পরিবর্ত মিডফিল্ডার হাইদিরভ। বক্সের বাঁ দিক থেকে নেওয়া ফ্রি কিক বারের নীচ দিয়ে গোলে ঢোকার আগেই তা ফিস্ট করে বারের ওপর দিয়ে বার করে দেন গোলিকিপার প্রভসুখন গিল। এই প্রথম পরীক্ষার মুখে পড়েন তিনি।
ব্যবধান বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মিনিটের মাথায় সেলিসের জায়গায় পিভি বিষ্ণুকে নামান অস্কার ব্রুজোন। মূলত ডানপ্রান্ত দিয়ে আক্রমণে ওঠা শুরু করেন তিনি। ৮৪ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় গোল পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ আসে শৌভিক চক্রবর্তীর কাছে, যখন তাঁকে প্রায় গোলের বল সাজিয়ে দেন নাওরেম মহেশ। কিন্তু শৌভিকের শট অল্পের জন্য গোলের বাইরে চলে যায়।
নির্ধারিত সময়ে শেষ পাঁচ মিনিটে গোল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে আর্কাদাগ এবং ৮৭ মিনিটের মাথায় মেসি বৌলিকে পরাস্ত করে বাঁ দিক দিয়ে বক্সে ঢোকা তির্কিশভ ফাউল করেন শৌভিক। রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে দেরি করেননি এবং সেই পেনাল্টি থেকেই গোল শোধ করেন পরিবর্ত ফরোয়ার্ড আলতিমিরাত আনাদুর্দিয়েভ। এই গোলের পরেই ক্লেটন সিলভা মাঠে আসেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। উল্টে আরও এক গোল খায় ইস্টবেঙ্গল।
সংযুক্ত সময়ের শেষ দিকে ডান প্রান্ত থেকে বল নিয়ে বক্সে ঢুকে বক্সের মাঝখানে আনাদুরদিয়েভকে ক্রস পাঠান সাপারমামেদভ। তখন গোলে শুধুই গিল। পেনাল্টি স্পটের কাছ থেকে গিলের ডানদিক দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন প্রথম গোলের নায়ক আনাদুরদিয়েভ। এই গোলের মিনিট খানেক আগেই বাঁ প্রান্ত থেকে মহেশের ফ্রি কিকে হেডে গোল করার সুযোগও নষ্ট করেন ক্রেসপো। আসলে এ দিন এত গোলের সুযোগ হাতছাড়া করারই খেসারত দিতে হয় লাল-হলুদ ব্রিগেডকে।