
।। সুমন গঙ্গোপাধ্যায়।।
অপেক্ষার ৫৫ দিন, শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার সন্দেশখালি’র ‘বেতাজ বাদশা ‘ শেখ শাহজাহান। বুধবার মিনাখা থেকে গ্রেফতার করা হয় এই প্রভাবশালী তৃণমূল নেতাকে। বসিরহাট আদালতে তাকে তোলা হলে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারপতি। পাশাপাশি বৃহস্পতিবারই ছয় বছরের জন্য বহিষ্কার করা হলো সন্দেশখালি এই মুকুটহীন সম্রাটকে ইতিমধ্যেই সন্দেশখালি নিয়ে ময়দানে বিরোধীরা। রাজ্য ছাড়িয়ে এখন গোটা দেশের কাছে অন্যতম ইস্যু এই সন্দেশখালি। এমনকী খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখেও সন্দেশখালির নাম। তবে এসবের মধ্যেই বুধবারে গ্রেপ্তার করা হলো শেখ শাহজাহানকে। আর এই গোটা বাংলা ঘটনার পিছনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মাস্টার স্ট্রোক দেখছেন রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ। কি কারণে? একটু ব্যখ্যা করা যাক।
রেশন দুর্নীতি মামলায প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ঘনিষ্ঠ শেখ শাহজাহানের বাড়িতে তদন্ত করতে এসে বাধার মুখে পড়ে ইডি। এমনকী আক্রান্ত হতে হয় এই কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকদের। গোটা ঘটনা নিয়ে শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে সন্দেশখালি থানায় লিখিত অভিযোগ করে ইডি। পরবর্তীতে
শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের জমি দখলে অভিযোগ ওঠে,পরবর্তীতে সরাসরি সন্দেশ খালি মহিলারা রীতিমতো দিনের পর দিন শাহজাহান বাহিনীর দ্বারা তাদের ওপর নারকীয় অত্যাচারের অভিযোগ তোলেন।তবে এত কিছুর পর সরকার কেন চুপ তা নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। এরই মধ্যে চলতি মাসের ১৬ তারিখ বিধানসভাতে দাঁড়িয়ে শাহজাহানের পাশেই দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের এই বক্তব্যে কার্যত আগুনে ঘি পড়ার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় এক কথায় বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে কার্যক গোটা দেশের ইসু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সন্দেশখালি। পরিস্থিতি এক কথায় সরকারের হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। এমনকী সন্দেশখালি র সঙ্গে নন্দীগ্রাম- সিঙ্গুর প্রসঙ্গ টেনে সরকার পরিবর্তনের ডাক দেয় শুভেন্দু- সুজন- অধীররা।প্রশ্ন ছিল একটাই কেন গ্রেফতার করা যাচ্ছে না শেখ শাহজাহানকে? আস্তে আস্তে বাড়ছে জনরোষ। এলাকায় একজোট মহিলারা। আর এই সন্দেশখালিকে সামনে রেখেই গোটা রাজ্যেই সরকারের প্রতি ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে মহিলাদের। সেই মহিলা যাদের জন্য লক্ষীর ভান্ডার থেকে শুরু করে কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক মহলের মতে এই ক্ষোভ লোকসভার আগে যথেষ্টই চিন্তায় রাখছে রাজ্যে শাসক দলকে। এর আগে গ্রেফতার হয় শিবু হাজরা- উত্তর সর্দার, আর শেষ পর্যন্ত জালে শাহজাহান।
আর বলা যেতে পারে এখানেই কার্যত ‘রাজনৈতিক ‘ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ক্লিন-বোল্ড’ করে দিলেন ‘রাজনীতিবিদ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন? গোটা সন্দেশখালি বা শাহজাহান ইস্যুতে প্রথম থেকেই চুপ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বিষয়ে প্রথম মুখ খোলেন ২৫ ফেব্রুয়ারি, বজবজে একটি ব্রীজ উদ্বোধনে এসে। অর্থাৎ বিধানসভায় শেখ শাহজাহান-এর পাশে দাঁড়ানোর ৯ দিন পর। সেদিন সাংবাদিক দের মুখোমুখি হয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট করে দেন- আদালতের কারণেই গ্রেফতার করা যাচ্ছে না শেখ শাহজাহানকে। এমনকী সরাসরি চ্যালেঞ্জ ও করেন যে শেখ শাহজাহনের বিরুদ্ধে তদন্ত ও গ্রেফতার না করার রক্ষা কবচ তুলে নিলেই গ্রেফতার হবে সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা।
কার্যত এই অভিযোগের পর পরই শাহজাহানকে গ্রেফতারির বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করে হাইকোর্ট। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার সন্দেশখালির স্বঘোষিত ‘বাদশা’। স্পষ্ট করে মনে রাখতে হবে, গোটা ইস্যুতে প্রথম থেকেই নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন তৃণমূলের ‘ যুবরাজ’। তবে ২৫ তারিখের পর এই বিষয়ে হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিৎ দাসের বক্তব্য , ” এই ইস্যুতে এককথায় মাস্টার স্ট্রোক দিলেন অভিষেক। দেখুন এটা বাস্তব, সন্দেশখালি ইস্যু প্রথম থেকেই রাজ্যের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল, যে ভাবে বিক্ষোভ হচ্ছে বা স্থানীয় মানুষদের পাশাপাশি বিরোধীরাও যে ভাবে চাপ বাড়াচ্ছে তাতে গোটা পরিস্থিতি অনেকটাই রাজ্যের হাতের বাইরে চলে গিয়েছে, সমস্যা আরও বেড়েছে বিধানসভাতে খোলাখুলি মুখ্যমন্ত্রীর শাহজাহানের পাশে দাঁড়ানোয়। খোদ প্রশাসনিক প্রধান মূল অভিযুক্তের পাশে দাঁড়ানোয় সেই ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। পাশাপাশি তা যেমন সন্দেশখালি ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যে ছড়িয়েছে, অপরদিকে বিরোধীরাও চাপ বাড়াচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ভোটের আগে তৃণমূলের ড্যামেজ আটকালেন অভিষেক।” তার আরও ব্যখ্যা, ” মনে রাখবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিউ জেনারেশন লিডার, আর তাই স্বাভাবিকভাবে যুবদের রিপ্রেজেন্ট করছেন তিনি। আর ইয়ুথরা যে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দুর্নীতি সঙ্গে সাধারণত আপোষ করতে চায় না সেই বার্তাও অভিষেক দিলেন। “একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতকে ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে দেওয়ার পরই শাজাহানকে গ্রেফতার করতে কোনো সমস্যা নেই তা স্পষ্ট করে দেয়, এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বলার পরই কার্যত গ্রেফতার করা হলো শাহজাহানকে। এবং তা করলো রাজ্য পুলিশ। এই গ্রেফতার একদিকে যেমন রাজ্য পুলিশ এর উপর ভরসার জায়গাতৈরী হলো, অপরদিকে প্রশ্ন উঠছে ইডির ভূমিকা নিয়ে। বিশেষ করে প্রায় ৫৫ দিন কেটে গেলেও কেন শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে কোনও উদ্যোগ এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট নিলোনা? তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশ্বজিৎ দাস এর বক্তব্য, ” খুব সোজা কথায় বলতে গেলে ঘটনা ঘটার প্রায় পঞ্চান্ন দিন কেটে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকে শাহজাহানকে গ্রেফতার করার মতো খুব একটা উদ্যোগ দেখা না গেলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দেওয়ার মধ্যেই গ্রেপ্তার হল শাজাহান। যেখানে বিরোধীদের কোন মূল দাবিই ছিল শাহজাহানের গ্রেফতারি। তা বুদ্ধি করে অনেকটা ম্যানেজ করে নিলেন অভিষেক। এমনকি আরামবাগ এবং কৃষ্ণনগরের সভা থেকে এই ইস্যুতেই যে প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতৃত্ব সুর চরিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে দায়ী করতেন সেই গ্রেফতারি হওয়ায় কার্যত বিজেপির একটা বড় ইস্যু ভোতা হয়ে গেল। ” উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার নিজের বক্তব্যে শেখ শাহজাহান গ্রেফতারের প্রায় পুরো কৃতিত্ব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দিয়েছেন কুনাল ঘোষ। একথা ঠিক অনেক পরে ময়দানে নেমে শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করার মতো পরিস্থিতি তৈরী ও একই দিনে সন্দেশখালির ‘ বাদশা ‘
বহিষ্কার করিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও দলের নাম ব্যবহার করে কোনই দুর্নীতিকে তিনি রেয়াত যেমন করেন না, পাশাপাশি জনগনের কাছে ‘ অপ্রিয়’ কোনো নেতা তা সে যতোই ক্ষমাতাবান বা প্রভাবশালী হোক তার ডানা ছাটতে খুব একটা ভাববেন না অভিষেক, এর পাশাপাশি এটাও প্রমাণ করলেন প্রশাসনের রাশ আসলে তাঁরই হাতে। বুঝিয়ে দিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনিই।