
সুমন গঙ্গোপাধ্যায়: তবে কি ডিফেন্সিভ খেলছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? আপাততঃ এই প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বারবার। কেন উঠছে এই প্রশ্ন?
ইস্যু নম্বর ১- রাহুলের ন্যায় যাত্রা, আর তা নিয়ে আপত্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই যাত্রা বাংলায় আসতে কার্যত কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ মমতার। এমনকী ইন্ডিয়া জোটে থাকলেও তিনি যে কোনো ভাবে বাংলায় কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতাতে যাবেন না, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস- তৃণমূল হাত মিলিয়ে চলা কার্যত বিশ বাও জলে। খুব ভাল করে দেখতে গেলে এককথায় না বাংলায় জোট হচ্ছে না। এখানেই শেষ নয়, পরিস্থিতি এমন যে একাধিক সভা থেকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এই ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকলেও এই জোটের দল গুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখার জন্য তৈরি ইন্ডিয়া জোটের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্ত আশ্চর্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতার বিরোধিতা করলেও গোটা বিষয় নিয়ে চুপ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইস্যু-২, ১০০ দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা । তার বিরুদ্ধে রেড রোডে অবস্থানে অনুপস্থিত সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।এখানেই শেষ নয়, শনিবার সোস্যাল মিডিয়া তে একটা পোস্ট,
তা নিয়ে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। অদিতি গায়েন, যিনি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোনের মেয়ে। সম্পর্কের হিসাবে যিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর পিসির মেয়ে। তৃণমূল সম্পর্কে যারা যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল তারা নির্দিষ্ট ভাবে জানেন এই অদিতি গায়েনই বর্তমানে ক্যামাক স্ট্রীটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর রাজনৈতিক প্রায় সমস্ত কাজই দেখাশোনা করেন। সেই অদিতি নিজের ফেসবুক একাউন্ট এ লেখেন,-” যোগ্য ব্যক্তিরা স্থান পায় না,
অযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ঘর সাজায়।” আর তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই নবীন- প্রবীণ নিয়ে কার্যত দুইভাগ তৃণমূল। এর আগে অভিষেক ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তৃণমূলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ প্রথম এই নবীন- প্রবীণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, রাজনৈতিক মহলের মতে, যা এককথায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই চ্যালেঞ্জ জানানো। কারণ রাজনৈতিক সমীকরনে এক কথায় যারা ‘প্রবীণ ‘, তাঁরা নেত্রী বলে মনে করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই , তবে বাগডোগরা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কার্যত কোনাল ঘোষের বক্তব্যকেই শীলমোহর দেন অভিষেক। পাল্টা এই ইসুতে কুনাল ঘোষকে তীব্র আক্রমণ করেন ফিরহাদ হাকিম। যদিও পরবর্তী সময়ে অভিষেক- কুনালের বক্তব্যকে সরাসরি খারিজ করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে তৃণমূলের অন্দরে এখন ‘নবীন- প্রবীণ ‘ নিয়ে ছায়া যুদ্ধ। এমন অবস্থায় এই দুটি ইস্যুতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে।
এবার একটু বিশ্লেষণে আসা যাক, ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়া জোট নিয়ে বাংলায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। অথচ এই জোটে ” অফিসিয়ালি ” থাকা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা বিষয় নিয়ে স্পিকটি নট। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিৎ দাসের বক্তব্য, ” এর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জোটের মুখ
হলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই জোটের সরাসরি অংশ। আর সেটা মাথায় রেখেই এই বিষয় চুপ তিনি। কারণ অনেক গুলো দরজা খোলা রাখতে চাইছেন অভিষেক। মানে দেখা গেলো শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্ব র সাথে কথা বলে বাংলা ও রাজ্যের বাইরে কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতার রফা সূত্র বের করলেন অভিষেক। দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই জোটের কোর কমিটি তে আছেন অভিষেক, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসা বা জোটের বিরুদ্ধে কিছু বলা জাতীয় রাজনীতিতে অভিষেকের ভাবমূর্তি কে যথেষ্ট আঘাত করবে।” বিশ্বজিৎ দাসের আরও ব্যখ্যা,” সব থেকে বড় বিষয় এই বিষয় চুপ থেকে এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন অভিষেক। শেষ পর্যন্ত যদি জোট না হয়, খুব সহজে জোট ভাঙার দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন তৃণমূলের সাধারন সম্পাদক, পাশাপাশি এই জোট ভাঙার দায় এসে পড়বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর। এবং রাজ্যে জোট ভাঙার কারণে ইতিমধ্যেই বিজেপি ঘনিষ্ঠ তা র অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে, সেই অভিযোগ থেকেও মুক্ত হবেন। একদিকে যেমন জাতীয় স্তরে গুরুত্ব কমবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, অপরদিকে জোট নিয়ে নীরব থেকে ইন্ডিয়া জোটের কোর কমিটিতে থেকে জাতীয় স্তরে নিজের গুরুত্ব বজায় রাখবেন তিনি।”
দ্বিতীয় বিষয়, রেড রোডের বিক্ষোভ সমাবেশে
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর অনুপস্থিতি। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, যে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া নিয়ে রেড রোডে বিক্ষোভ সমাবেশ করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিরতে এই একই ইস্যুতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রীর ঘরে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। অথচ সেই ইস্যু নিয়ে রেড রোডে বিক্ষোভে নেই অভিষেক! উল্লেখ্য, এই কর্মসূচীতে যোগ দেওয়ার জন্যে দলীয় সাংসদদের কলকাতায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন দলনেত্রী, কিন্ত তা সত্ত্বেও কলকাতা ফিরে আসেন নি অভিষেক। বিশ্বজিৎ দাসের ব্যখ্যা, ” আসলে দলের নিয়ন্ত্রণ যে তাঁর হাতে সেটা বোঝাতে এই বিক্ষোভে অভিষেককে পরিকল্পনা করেই যোগ দিতে মানা করেন দলনেত্রী। ভালো করে দেখবেন অভিষেকপন্থী কোনো নেতাই কিন্ত এই কর্মসূচীতে যোগ দেন নি। একদিক থেকে দেখতে গেলে এই কর্মসূচী থেকে ‘প্রবীণ’দের নিয়েই নিজের কর্মসূচী সফল করে দেখালেন। এর পাশাপাশি মঞ্চ থেকে অভিষেক এমন কোনো মন্তব্য করেন যা সেই নবীন- প্রবীণ ইস্যুকে উস্কে দেয়।” রাজনৈতিক মহলের মতে, অভিষেক গুরুত্ব পেয়ে যায়, এই মুহূর্তে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে নারাজ মমতা। আর তাই অভিষেকের হাতে তৈরী ইস্যু কার্যত হাইজ্যাক করে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্বজিৎ দাস এর ব্যখ্যা, ” রাজনৈতিক ভাবে বুদ্ধিমান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সব বিষয় আঁচ করেই মঞ্চ এড়িয়ে গেলেন তিনি।