
ত্রয়ণ চক্রবর্ত্তী: সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কিংবা অক্টোবরের শুরু। মেঘ-বৃষ্টির ঘনঘটা কেটে হঠাৎ এক রোদে শরীর আর্দ্র হলে পুজো পুজো,এই তো আসছে এমন মনে হয় না মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এরপর দিন এগাতে থাকলে নীল আকাশ,পেজা তুলোর মতো মেঘ,শহরতলিতে হঠাৎ চোখের গোচরে আসা কালফুল এলে বলাই বাহুল্য, মন মনে বলে ওঠে এই তো দূর্গ্গা আসছে ঘরে। মাটি তখন হয়ে যায় মায়া। রাস্তার মোড়ে রোজ যেখানে অটো,টোটো বা রিক্সা স্ট্যান্ডটা থাকে,খানিক পথ বদলে নেয় তারা। কারণ শারদোৎসবের পাড়ার মন্ডপটা যে শুরু হয়ে গেছে। পন্টু বা হরেনরা মাসিমা জেটিমাদের টোটো বা রিক্সায় ওঠার আগে বলে দেয়, পুজো সামনে দুটাকা অতিরিক্ত ভাড়া লাগবে। পড়ুয়া হোক বা চাকুরীজীবী মন বসে না আর কাজে। ভিড় জমে হাতিবাগান থেকে গড়িয়াহাটে। নতুন জামার গন্ধ দোকান থেকে বেরিয়ে মিশে যায় উত্তর থেকে দক্ষিনের সরু গলির খারাপ টিউবকলটার গায়ে।
মন্ডপ বা প্রতিমার বিবর্তন বারবার ঘটেছে বাংলায়। বাড়ির পুজোর উমা হয়েছে বারোয়ারী দূর্গ্গা। মন্ডপে মন্ডপে সমস্বরে উঠেছে বলো দূর্গ্গামাইকি। তেমনই পালটেছে মন্ডপ ও শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতির আদল। প্রথম পরিবর্তন সত্তরে দশকে বলা যায়। অগ্নিযুগের সেসময় সিনের পুজোর আধিক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। মন্ডপ হয়ে উঠতো নীল আকাশ তাতে দেখা যেত সাদা কাটা কাটা মেঘ। হিন্দি ছায়াছবির যুগে মা দূর্গার মুখের আদল অনেক জায়গাতেই হত সেইসময়ের জনপ্রিয় নায়িকার মুখের মতো। আর মহিষাসুর, নাহঃ জানি বুঝতে পেরেছেন আপনারা,হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন সেইসময়ের কোনও ভিলেন বা চলচিত্রের খলনায়কের মুখের আদলে। রফি,কিশোরের হিন্দিগানে মসগুল হয়ে থাকতো পাড়াগুলো। পরবর্তী আশির দশকে এই রীতির পরিবর্তন চোখে পড়ল। ফিরে এল সাবেকি মন্ডপ। ডাকেরসাজের প্রতিমা। আধিক্য কমল হিন্দিগানে,মাইকে বাজলো হেমন্ত,শ্যামল,মানবেন্দ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়রা। জীবন,সময় পরিবর্তনশীল,তা সঙ্গে পাল্লা দিতেই হয়। প্রগতির গুঁতোতে উদার হল দেশ। আর তার সঙ্গে আবারও পরিবর্তন হল বাঙালির আদরের শারদীয়ার। নব্বইয়ের শেষের দিকে হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল থিম। সাবেকি কলেজ স্কোয়ার,মহম্মদ আলি পার্ক,একডালিয়া এভারগ্রীনের সঙ্গে সমান্তরালে এল বোসপুকুর শিতলা মন্দির,চেতলা অগ্রীন,সুরুচি সংঘের মতো থিম পুজো। ষষ্ঠীর বোধনে নয়,পুজোর শুরু হলো বাঁশপোতার দিনে। কর্পোরেট নাম হল খুঁটি পুজো। হোডিং পুজোও লক্ষ করা যায় এখন।
তবে এত বিবর্তনের মধ্যেও অমলিন শরতের শারদীয়া। শরতকাল মানুষের অবয়বে ভেবে কোনও কোনও ভাবুক ব্যাখ্যা করে ছোট্ট মনে ছটফটে কিন্তু বাইরে ভীষন গম্ভীর গম্ভীর ভাব। কিন্তু গম্ভীর হলে হবে কী ওই যে মনে ছটফটে,তাই তো শত খারাপ লাগার মধ্যেও এইসময় সারা বছরের অক্সিজেন নিয়ে নেয় আট থেকে আশি। চেনা চোখের চোরা দৃষ্টিতে তৈরি হয় সম্পর্ক। সেসব সম্পর্ক সম্পর্ক হয়ে না উঠলেও শরতের পেজা তুলোয় ভর করে প্রতিবার ফিরে আসে এই সময়,জীবন স্মৃতির মণিকোঠায়। যেমন বারবার ফিরে আসে শারদোৎসব।
ওঙ্কার নিউজের পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে রইল শারদীয়ার শুভ কামনা।