
তাপস মহাপাত্র : ক্ষেত্র যাই হোক না কেন, মানুষকে জীবনীশক্তি জোগায় তার সংগ্রাম। গীতায়ও আমরা এর সমর্থন পাই, যেখানে কর্মযজ্ঞের কথা বলা আছে। এই কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে শারীরিক অক্ষমতাকে জয় করে বিশ্বে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছিলেন একজন নারী, যিনি একাধারে এক বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী, আবার সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামীও। নাম- ফ্রিদা কাহালো। জন্ম ১৯০৭ সালে। জন্মসূত্রে ম্যাক্সিকান। ছোটবেলায় পোলিওতে আক্রান্ত, যা তাঁর ডান পা-কে অক্ষম করে দেয়। দুর্ভাগ্য এখানেই থেমে ছিল না। তাঁর যখন বয়স ১৮, ভয়াবহ এক বাস দুর্ঘটনার শিকার হন। তাতে তাঁর মেরুদন্ড, পা এবং পাঁজরে গুরুতর আঘাত লাগে। এতে শরীর আরও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। চিকিৎসকরা বলেছিলেন তিনি আর হাঁটাচলা করতে পারবেন না। তবু তিনি হার মানেননি। এই যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে তিনি তুলে নিয়েছিলেন রঙতুলি। প্রতিটি ক্যানভাসই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের কুরুক্ষেত্র। ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন এক চরম দ্বন্দ্বময় চরিত্র। নিজের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা নিঙড়ে তিনি ভেজাতে থাকেন রঙ, ফুটিয়ে তুলতে থাকেন মানুষের সত্যচেতনা। যিনি আবিষ্কার করেছিলেন সংগ্রামের নব দিগন্ত ও তার তাৎপর্য।
শরীরের অক্ষমতা ও তার যন্ত্রণা নিয়ে তাঁকে চলতে হবে, এটা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। তাই এই দুই অন্তরায়কে জীবনের স্বাভাবিক প্রকৃতি ধরে নিয়ে তিনি এগিয়েছিলেন তাঁর নির্মিত জীবনে। উপসম হিসেবে তুলে নেন সৃষ্টিকে। যার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর চেনা ব্যথাকে ফুটিয়ে তুলতে থাকেন বাস্তব ও প্রতীকীর সংমিশ্রণে। যার অন্যতম উদাহরণ “দ্য ব্রোকেন কলাম”। তাঁর এই চিত্রকর্মে দেখা যায়, শরীরের মধ্যে ঢুকে আছে ধাতব কাঁটা, ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেরুদণ্ড, দেহের গভীর ক্ষত, যা তাঁর শারীরিক যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে মনের আবাস গড়ে তুলতে পেরেছে। এখানেই শিল্পীর সার্থকতা। সেই দুরূহ এবং অব্যক্ত কষ্ট ফুটে উঠেছে ক্যানভাসে, রঙে ও তুলির টানে।
শারীরিক যন্ত্রণায় আচ্ছাদন নিয়ে তাঁর জীবনে যখন প্রেম আসে তখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কিছু। এই নিয়ে ডিয়েগো রিভেরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা জানা যায়। ডিয়েগো ছিলেন সেইসময় মেক্সিকোর সবচেয়ে নামকরা শিল্পী এবং রাজনৈতিক ভাবে কম্যুনিষ্ট। যদিও এই সম্পর্ক এক্কেবারেই সরল ছিল না। ফ্রিদা ও ডিয়েগোর সম্পর্ক ছিল ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা, পুনর্মিলন, বিচ্ছেদ এবং মানসিক সংগ্রামের এক জটিল মিশ্রণ। এই সম্পর্কের ব্যাপারে ফ্রিদা বলেছিলেন-
“আমি আমার জীবনে দুটি ভয়ানক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। একটি হলো বাস দুর্ঘটনা, যা আমার শরীরকে ভেঙে দিয়েছিল। আরেকটি হলো ডিয়েগো, যে আমার হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছিল।”
বারংবার দুর্যোগের মধ্যে পড়লেও, ফ্রিদা কখনো ভেঙে পড়েননি। একজন নারী হিসেবে তাঁর এই জীবন দর্শন বিশ্বের সকল নারীর কাছে এক শিক্ষনীয় নজির। যা তাঁর সৃষ্টির মধ্যেও বারবার আলোকিত হয়েছে। ১৯৩৯-এর একটি চিত্রকর্ম “দ্য টু ফ্রিদাস”-এ তাই আমরা দেখি রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে বসে থাকা এক জেদী নারীকে। যেখানে নিজের অস্তিত্বের দুটি বিপরীত সত্তার প্রবল দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে।
ফ্রিদার শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তাঁর আত্মচিত্র। এমন বহু চিত্রে আমরা ছুঁতে পারি তাঁর প্রবল মানসিক যন্ত্রণাকে। যেখানে ব্যথাতুর রঙে ফুটে ওঠে তাঁর স্বপ্রতিকৃতি, প্রতীকবাদ এবং বেদনাদায়ক আত্মবিশ্লেষণ। এইসব ব্যক্তিগত দহন ও ক্ষয়ের ভিতর থেকে উঠে আসে তাঁর সংঘাতপূর্ণ প্রেম। ফলে মনে হতে পারে, তাঁর শারীরিক যন্ত্রণা তৈরি করেছে এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সরব হয়ে উঠেছে নিভৃত শক্তি, দহন এবং দ্রোহ। যা তাঁকে পৃথিবী জুড়ে নারীবাদী প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফ্রিদা কাহলোর সমস্ত সৃষ্টির চরিত্রই হল আত্মপ্রতিকৃতি, মেটাফোরিক্যাল ইমেজ। বহুক্ষেত্রে দেখা যায় বডি পলিটিক্সের উপস্থিতি, আঙ্গিকে পাওয়া যায় পুনরাবৃত্তিমূলক প্রতীক, যেমন হৃদয়, শিকড়, পশুপক্ষী, এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বৈশিষ্ট্যে মেলে মেক্সিকান লোকশিল্পের প্রভাব, রঙের জোরালো ব্যবহার, দুঃখ ও বেদনার প্রকাশ, এবং আধ্যাত্মিক ও শারীরিক বেদনার চিত্রায়ণ। এরকমই এক চিত্র “হেনরি ফোর্ড হসপিটাল”। ১৯৩২ সালে আঁকা। যেখানে প্রতীক হয়ে উঠেছে মাতৃত্বের বেদনা। এই চিত্রশিল্পে ফ্রিদা যেন শুয়ে আছেন নগ্ন অবস্থায়, রক্তাক্ত দেহাংশ, তার গর্ভপাতের প্রতীক হিসেবে তাঁর শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন বস্তু ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। যা তাঁর শারীরিক ব্যথা ও মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করে।
এভাবেই সারা জীবন তিনি তাঁর শিল্পকর্মের ভিতর দিয়ে এক সংগ্রামী নারীকে গড়ে তুলেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন কোনো বাধাই নারীকে দমিয়ে রাখতে পারে না। প্রতিটি নারীদিবসে তাই তিনি নতুন করে প্রেরণা নিয়ে আসেন।