
ওঙ্কার প্রতিনিধি ইন্দ্রানী চক্রবর্তীর মুখোমুখি শিপ্রা চক্রবর্তী
সুবহ কা আসমান
অব লাল নহী হোতা
হর জাগতী সুবহ রেইড হোতি হ্যায়
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে অধিকার কর্মী সীমা আজাদ এনআইএ-র রেইড সম্পর্কে লিখেছিলেন। ঠিক এক বছর পর আর একজন অধিকার কর্মী প্রত্যক্ষ করলেন সেই ‘রেইডেড সুবহ’। গত প্রায় কুড়ি বছর যাবৎ আসানসোলের কোলিয়ারি চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক অধিকার কর্মী শিপ্রা চক্রবর্তী সোদপুরের বাসিন্দা। গত ১লা অক্টোবর সাত সকালে এনআইএ অভিযান হয় শিপ্রা চক্রবর্তীর সোদপুর পল্লিশ্রীর বাড়িতে। ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর মুখোমুখি অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন তিনি।
প্রশ্ন:- ১তারিখ সকালে ঠিক কী হয়েছিল?
শিপ্রা:- সকাল ৬টাও বাজেনি, তখনও ঘুমাচ্ছি, হঠাৎ জোরে দরজার তালা ঝাঁকানোর আওয়াজ। ও (মানবেশ সরকার, শিপ্রা চক্রবর্তীর সঙ্গী) আর আমি দুইজনেই ভেবেছি রান্নার দিদি এসেছে। ও গেট খুলতে যায়, আমি ঘুম থেকে উঠে স্বভাবতই বাথরুমে গেলাম। আমি তো বুঝতেই পারিনি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি মহিলা পুলিশ দাঁড়িয়ে। আমায় বলল, “দিদি তৈরি হয়ে নিন কথা আছে।” ওদের কাজ শুরু হতেই আমি ভাবছি এত পুলিশ কেন?
প্রশ্ন:- কতজন পুলিশ এসেছিল?
শিপ্রা:- এনআইএ, এসটিএফ, ব়্যাফ মিলিয়ে জনা পনের পুলিশ। এই দুটো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আমায় জানানো হল ওনারা রাঁচি এনআইএ থেকে এসেছেন।
প্রশ্ন:- হঠাৎ এই অভিযান কেন? কী মনে হয়?
শিপ্রা:- আমি তো জানিনা, তবে ওরা বলেছে আমার নামে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে, আমাকে দেখিয়েওছে। আমায় জানানো হয়েছে যে ২০২২ সালে প্রশান্ত বসু অ্যারেস্ট হয়েছেন, তাঁর তদন্ত প্রক্রিয়ায় আমার নাম উঠে এসেছে তাদের ভিত্তিহীন আবদার। সেই তদন্তের সাথেই আমাকে তারা সন্দেহ করেছে আর মামলায় জুড়তে চাইছে বলে মনে হয়।
প্রশ্ন:- হঠাৎ আপনাকেই কেন? কিছু সংবাদ মাধ্যম ব্যাপারটার সাথে চলমান তিলোত্তমার আন্দোলনের যোগসূত্র দেখছে।
শিপ্রা:- কারা দেখছে? এটা তো সম্ভবই নয়। আমি তো এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো আমিও যুক্ত হয়েছি একজন মেয়ে হিসেবে। তার জন্য আমার বাড়ি রেইড করবে কেন? অবশ্য এটা হতে পারে যে আমি এটাকে সমর্থন করি তাই। এখন এই আন্দোলনের একটা স্বতঃস্ফূর্ততা আছে। মেয়েরা, এমনকি শাসকদলের মেয়েরা পর্যন্ত এই আন্দোলনের জোরে একটা আওয়াজ পেয়েছে। একজন মেয়ে হিসেবে এটাকে তো সমর্থন করতেই হয়।
প্রশ্ন:- আপনি বললেন যে প্রশান্ত বসুর মামলায় আপনাকে যুক্ত করতে চাইছে। ২০২১ সালে প্রশান্ত বসু অ্যারেস্ট হয়েছেন, তারপর লাগাতার এনআইএ অভিযান চলছে। এই নিয়ে আপনার কী মত?
শিপ্রা:- রাষ্ট্র আছে, তাঁর এজেন্সি আছে। তাদের কাজ রাষ্ট্রকে রক্ষা করার, তারা তা করবেন। কিন্তু কিছু নগণ্য চার্জের উপর ভিত্তি করেই তারা অভিযানের আগে ও পরে যে আবহ তৈরি করেন তা একটা অপরাধীকরণের প্রচেষ্টা। এই যেমন ঘরে ঢুকেই মনে হয়েছে এত পুলিশ কেন। পাড়ার লোক পরে জানিয়েছে বাইরে অন্ততঃ ২৫-৩০ জন পুলিশ ছিল, কেউ খাকি তো কেউ জংলা পোশাকে। তাছাড়া বাড়ির এন্ট্রান্সের চারদিকের গুলিগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্ততঃ চার পাঁচটা গাড়ি ছিলই। আমার রিলেটিভরা তার পর থেকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে, রান্নার দিদি কাজ করতে আসছে তো? অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক পরিবেশে গোয়েন্দারা এমন বার্তা দিতে চান যে আপনি যাকে যেমন চেনেন তিনি কিন্তু ঠিক তেমনটা নন।
প্রশ্ন:- হ্যাঁ, কারণ স্থানীয় মানুষের কাছে ভাবমূর্তি বদলের একটা পরিস্থিতি থাকছেই।
শিপ্রা:- একেবারেই, রিপোর্টারদের মধ্যে একজন ওইদিন আমায় প্রশ্ন করেছেন এটা আমার কাছে মান সম্মানের বিষয় কি না। আমার পাড়ার লোকের সাথে আমার যোগাযোগ ভালো তাই এটা আমার কাছে মান সম্মানের বিষয় নয়। আর আমার কেন মান সম্মানের বিষয় হবে, আমি তো অপরাধ করিনি? কিন্তু এটা একটা ভ্যালিড প্রশ্ন। এনআইএ নিজের মতো কাজ করুক, গোয়েন্দারা তাদের মতো কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অপরাধীকরণ কেন?
প্রশ্ন:- আপনার কী কী জিনিস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে?
শিপ্রা:- আমার মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, একটা পেন ড্রাইভ, একটা ফাঁকা মেমরি চিপ, দুটো সিডি, কিছু কাগজপত্র এবং (একটু হেসে) আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিটা পর্যন্ত তারা বাজেয়াপ্ত করেছেন। এছাড়া আমার ফোনটি যখন তাঁরা নিচ্ছেন আমি একবার অনুরোধ করি যে আমি আমার ব্যক্তিগত কিছু ছবি ডিলিট করে দিতে চাই। ওনারা রাজি হননি কারণ ততক্ষণে তা তাঁদের হেফাজতে চলে গিয়েছে বলে তাঁদের বক্তব্য। তাঁরা যদিও আমায় অভয় দিয়েছেন, তবুও এটা অনুচিত।
প্রশ্ন:- ডিভাইস বাজেয়াপ্তকরণের পর সেই বিষয়ে কোনও রসিদ কি তাঁরা দিয়েছেন?
শিপ্রা দি:- না, যদিও এই বাজেয়াপ্তকরণের জন্য হ্যাশ ভ্যালু চাইতে হয় তা আমি আগে জানতাম না, কারণ এসব বিষয়ে অভ্যস্ত নই। পরে জেনেছি। তাই আমিও চাইতে পারিনি এবং ওনারাও দেননি। যদিও ওনাদের দেওয়া উচিৎ ছিল।
প্রশ্ন:- আপনি কোন সংগঠন করেন?
শিপ্রা দি:- অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, আন্দোলন, গবেষণা এবং সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা। আমরা অধিকারের পক্ষ থেকে মূলত আসানসোলের কনট্র্যাকচুয়াল খনি শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও আইনী অধিকর নিয়ে লড়াই করি।
প্রশ্ন:- কত বছর ধরে?
শিপ্রা দি:- ওই তো, ২০০৬ থেকে, মানে প্রায় ২০ বছর যাবৎ। অধিকার তখনই শুরু হয় আর আমিও তখন থেকেই যুক্ত।
২০২১ সালের ১২ই নভেম্বর ঝাড়খন্ডের চান্ডিল থেকে গ্রেফতার হন মাওবাদীদের ইস্টার্ন রিজিওনাল ব্যুরোর প্রাক্তন সম্পাদক প্রশান্ত বসু এবং শিলা মারান্ডি। পশ্চিমবঙ্গের সীমানার মধ্যেই ঝাড়খণ্ড পুলিশ তাঁদের ধরেন। তারপর থেকেই এনআইএ সহ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছেন রাজ্যের লেখক, অধ্যাপক, গবেষক, সমাজকর্মী সহ অনেকেই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এবং রাজ্যের গোয়েন্দাদের এই লাগাতার অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অভিযোগ বহুদিন ধরেই করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। যদিও গোয়েন্দাদের দাবি এই ‘আরবান নকশালরা’ অর্থ সাহায্য করে মাওবাদীদের। এইদিন এই সন্দেহেই শিপ্রা চক্রবর্তীর বাড়িতে অভিযান চালান তাঁরা।