
ইন্দ্রানী চক্রবর্তী ও সাগ্নিক দত্ত : শারদীয়ায় কলকাতার রাস্তাঘাট জমজমাট থাকেই, কিছু নির্দিষ্ট এলাকা বাদে। এমন একটি এলাকা হল ধর্মতলা। সারাবছর জ্যামে জর্জরিত থাকলেও কাছকাছি কোনও বড় পুজো না থাকায় এই সময়টায় ধর্মতলা ফাঁকাই থাকে প্রতি বছর। কিন্তু এই বছরটা অন্য রকম। আগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে আরজি কর মেডিকেল কলেজে নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে আন্দোলন। ডাক্তারদের আন্দোলন ডাক্তারি সীমানা পেরিয়ে পৌঁছেছে প্রান্তিক মানুষজনের মধ্যেও।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাজ্যবাসীকে আন্দোলন ছেড়ে উৎসবে ফিরতে বললেন, জনতা বেঁকে বসল। মানুষ সোচ্চারে বলল ‘উৎসবে ফিরব না’। কিন্তু এত বছরের অভ্যাস কাটানো মুশকিল। এদিকে মেট্রো চ্যানেলে বিচারের দাবিতে অনড় ডাক্তারদের অনশন শুরু হলে ধর্মতলাই হয়ে উঠলো পুজোর নতুন ডেসটিনেশন। সময় যত বাড়ছে, অসন্তোষ বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনতার ভীড়।
রাজ্য প্রশাসনের সাথে জুনিয়র ডাক্তারদের দরকষাকষির সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ল জনসমাগম। সকাল থেকে রাত কখনও কম কখনও অনেক বেশি মানুষ ঘিরে থাকে অনশন মঞ্চ। রাতের বেলায় জুনিয়র ডাক্তার ছাড়াও প্রচুর সাধারণ মানুষ এবং গণ আন্দোলন কর্মী অনশন মঞ্চের আশে পাশে গলায় ‘নো হর্ণ’ পোস্টার নিয়ে হ্যান্ড মাইকে চলতি গাড়ির উদ্দেশ্যে নিরলস ঘোষণা করে যান, হর্ণ দেবেন না। ডাক্তারদের অনশন মঞ্চে কখনও শিশুরা, কখনও অশীতিপর বৃদ্ধ বৃদ্ধারা পৌঁছে যান ভালোবাসা আর আশির্বাদ নিয়ে। আন্দোলনের জোরে জুনিয়র ডাক্তাররাও বার্তা দেন, আমরা সাধারণ মানুষ।
চেনামুখদের কথা পড়েন অনেকেই, অনশন মঞ্চের আশপাশের কিছু অচেনা মুখের কথা তাই তুলে আনছি।
সপ্তমীর বিকেল, রিষড়া থেকে তাঁর ১বছর ৩ মাসের সন্তানকে নিয়ে এসেছেন মনীষা বসু। বললেন, “রোজ তো আসা হয়না, আজ প্রথম এলাম। রোজ অবশ্যই আসা উচিৎ। আমরা রিষড়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে এসেছি। প্রথম দিন থেকে আমরা আন্দোলনে রয়েছি, নিজেরাও কর্মসূচি নিয়েছি। বারবার জুনিয়র ডাক্তারদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যতটা বেশি অনশনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে থাকা যায় এটাই আমাদের চেষ্টা।”
ঐদিনই জমায়েতের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পলিটেকনিক কলেজের অধ্যাপক সাগ্নিক দত্ত। এসেছিলেন শ্রীরামপুর থেকে। রোজই আসছেন, কিছু সময় থাকছেন অনশনকারী ডাক্তারদের সাথে। শখ ফটোগ্রাফি। ক্যামেরা হাতেই বললেন, “পঞ্চমীর দিন এসেছি তারপর আজকে। এছাড়া ৪ঠা সেপ্টেম্বরের রাত দখল থেকে প্রতিটা কর্মসূচিতেই থাকছি যতটা সম্ভব। চারদিকে যা চলছে; আরজি করে যা হল, তারপর হরিপাল, তারপর একটার পর একটা হয়েই চলেছে। তারপর মর্মান্তিক ঘটনা জয়নগরে। গ্রাম বা শহর বা শ্রেণী আলাদা করে নয়, সবার উপরেই আক্রমণ নামছে। এটাই প্রতিবাদ হচ্ছে, প্রতিবাদ করছি। এখান থেকে যদি বিচার আদায় না করা যায় তাহলে হয়তো কোনও জিনিসেরই বিচার পাওয়া যাবে না। এটাই লাস্ট স্ট্যান্ড। এখান থেকে বার করে আনতেই হবে, আর কোনও উপায় নেই।” অনশন মঞ্চে আসার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বললেন, “প্রশাসনিক অসহযোগিতা ছাড়া আর কিছুই অনুভূত হচ্ছে না।”
সোনারপুর থেকে এসেছেন সত্তরোর্ধ কাশী নাথ কোলে। ছেলে জোকা মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার, রয়েছেন আন্দোলনে। কাশীনাথ বাবু জানালেন, “প্রায়ই আসছি, মিছিলে হাঁটছি। যে অভয়া পরিক্রমা আটেকেছে সেখানেও ছিলাম। প্রতিবাদ তো করছিই, চেষ্টা করছি আরও মানুষ যাতে এগিয়ে আসে। আর প্রশাসন যা করছে সেটা অন্যায়। সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। তাই আমরা আন্দোলনের জোর বাড়াতে রোজ আসছি, অনশনরত ডাক্তারদের পাশে থাকছি।”
ওই দিনই জনসমাবেশের ডাক দেয় জুনিয়র ডাক্তাররা। পরের দিন অর্থাৎ জনসমাবেশের দিন এসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব একজন ডাক্তার। অনেকক্ষণ জমায়েতে থেকে সন্ধ্যার দিকে সপরিবারে বসে ছিলেন ট্রাম ডিপোর পাশে। হুগলীর পান্ডুয়া থেকে এসেছেন ডঃ মনিরুদ্দীন আহমেদ। পরিবার নিয়ে এসেছেন কলকাতার উৎসবে, ধর্মতলার অনশন মঞ্চে। বললেন, “নাতনি নীট দিয়েছে, একটুর জন্য পায়নি। আবার দেবে, স্বপ্ন তিলোত্তমার মতো আদর্শ প্রতিবাদী ডাক্তার হবে। ওর জন্যই আসা। কলকাতার উৎসবেই তো এসেছি, তাই অনশন মঞ্চেই আগে এলাম।”
অনশনের ১৯০ঘন্টা পেরিয়েছে, মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। টানা অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তনয়া, স্নিগ্ধা, অর্ণব, পুলস্ত্য এবং সায়ন্তনী। শুক্রবার, জনসমাবেশের পর যোগ দিয়েছেন আলোলিকা এবং পরিচয়। অনিকেত, অনুষ্টুপ আর উত্তরবঙ্গ মেডিকেলের অলোক বর্মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। বাকীরা মরণপণ লড়াই করার অঙ্গীকার করেছেন। সময় যত এগোচ্ছে, অসন্তোষ বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনতার ভীড়।