
সুমন গঙ্গোপাধ্যায়ঃ সন্দেশখালি। এই মুহূর্তে সম্ভবত সব থেকে আলোচিত। টেলিভিশন হোক বা খবরের কাগজ। টিআরপির দৌড়ে এই মুহূর্তে ভরসা উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি।
এই এলাকার বেতাজ বাদশা শেখ শাহজাহান এর খোঁজে ইডি আসা ও তাদের ওপর শাহজাহান বাহিনীর ‘সংগঠিত ‘ আক্রমণ এর পর শিরোনামে সন্দেশখালি। তবে মোড় ঘুরছে অন্যদিকে, প্রথমে যে সন্দেশখালি আটকে ছিল শুধুমাত্র শাহজাহানে, এবার সেই সন্দেশখালিতেই উঠে এলো আরো দুটি নাম, উত্তম সর্দার আর শান্তি হাজরা। এমনকী উঠে আসছে শাহজাহান বাহিনীর ‘অত্যাচার’ এর কাহিনীও। অভিযোগ, এই এলাকার একাধিক এই বাহিনীর হাতে অত্যাচারিত। এতদিন যে মহিলারা পর্দার আড়ালে ছিল, তারাই এখনও সরাসরি টিভি চ্যানেল বা খবরের কাগজের সামনে মুখ খুলতে শুরু করেছে, সন্দেশখালি যেন এক ‘অচেনা দ্বীপ’। আর এই সন্দেশখালি এই মুহূর্তে রাজনীতির অন্যতম ইস্যু। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেশখালিকে সামনে রেখে ময়দানে বিরোধীরা। রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ এই সন্দেশখালিকে নন্দীগ্রাম- সিঙ্গুরের সাথে তুলনা করতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন, লোকসভা নির্বাচনের আগে আদৌ কি এই ‘ মডেল সন্দেশখালি’ থেকে ফায়দা তুলতে পারবে বিরোধীরা? এই ইস্যু তে রীতিমত কোমর বেঁধে নেমেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী- সুকান্ত মজুমদাররা। পিছিয়ে নেই বাম- কংগ্রেসও। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল ঘুরে গিয়েছেন এলাকা, দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিয়ে একটু উচ্চ পর্যায়ের টিমও তৈরী করেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি।
পাশাপাশি বাম- কংগ্রেসেরও প্রতিনিধি দল গিয়েছে সন্দেশখালি, গিয়েছে কামদুনির মৌসুমি- টুম্পারাও। তবে বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছে বিরোধীদের। আর প্রশ্ন এখানেই। হাতে গোনা কয়েকদিন পর লোকসভা নির্বাচন। ঠিক তার আগে সন্দেশখালি । তাহলে কি সত্যি কি লোকসভার আগে এই ইস্যুতে রীতিমত ব্যাকফুটে তৃণমূল? এটা বাস্তব এই সন্দেশখালি নিয়ে যথেষ্ট চাপে রাজ্যের শাসক দল। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই ইস্যুতে ব্যাটিং করতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিধানসভাতে দাঁড়িয়ে এই অশান্তি নিয়ে মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী। শাহজাহানের পাশে দাঁড়িয়ে বহিরাগত তত্ত্ব তুলে ধরছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু একটা চাপ থাকলেও এই ইস্যুতে তৃণমূল ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা মানতে নারাজ বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিৎ দাস । তাঁর ব্যখ্যা, ” এটা ঠিক নির্বাচনের আগে আগে এই ধরনের ঘটনা সমস্ত শাসক কেই চাপে রাখে। তাই তৃণমূল যে একেবারে স্বস্তিতে সেটা বলা যেমন ভুল। আবার কিন্তু ব্যাকফুটে সেটাও নয় । দেখুন এর পিছনে সব থেকে বড় ব্যর্থতা বিরোধী দল গুলোর। সন্দেশখালিতে নকশাল বা আরএসএস-এর একটা পরোক্ষ মদত থাকলেও সেটা নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরের মতো সংগঠিত নয়, দ্বিতীয়ত, নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরে যেমন এলাকা তৎকালীন শাসক দলের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সন্দেশখালি কিন্তু এখনও তৃণমূলের হাতেই আছে।
পাশাপাশি, এই ঘটনা নিয়ে জনমানসে যতটা প্রতিক্রিয়া দেখা উচিত সেটা কিন্তু এখনও গোটা রাজ্যে নেই। ” এর পাশাপাশি তাঁর আরও বক্তব্য, ” বিরোধীদল হিসাবে বিজেপির ভূমিকা নিয়েও এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে, এটা একটা এলাকার সমস্যা, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে হিন্দু- মুসলিম তত্ত্ব টেনে এনে এই আন্দোলনকে অনেক টা রাজনীতিকরণ করে দিয়েছেন। এবং সত্যি কথা যেখানে সন্দেশখালিতে মহিলাদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ, সেই ইস্যু নিয়ে কিন্তু মহিলারাই রাস্তায় কোনও আন্দোলনে নেই। এই ইস্যুকে নিয়ে সরকার বদল করে দেওয়ার বা পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো আন্দোলন বা মুখ কোনোটাই এই মুহূর্তে বিরোধীদের নেই, তাই চাপে থাকলেও ব্যাকফুটে শাসকদল এটা এই মুহূর্তে বলা সঠিক হবে না।”
অপরদিকে আরও এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অভিষেক দে বিশ্বাস এর মতে, এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের নেগেটিভ বা পজেটিভ বলা বা বোঝার মতো সময় আসেনি।
তাঁর বক্তব্য, ” তৃণমূল বা সরকার ব্যাকফুটে কি না সেটা নির্ধারন করবে প্রশাসন আর সরকার কিভাবে গোটা বিষয়টা হ্যান্ডেলিং করছি তার ওপর নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরে গোটা বিষয় নিয়ে সরকার কার্যত পুরো বিষয়টি কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল তাই নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের আন্দোলন গোটা রাজ্যের পাশাপাশি গোটা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সেই রকম কিছু এখনো সন্দেশখালির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। পাশাপাশি এই দুই আন্দোলনে সাধারন মানুষের যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন বা যোগদান ছিল, তাও এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। এটাও সত্যি কথা এই ইস্যুকে পলিটিক্যালাইস করার মত মুখ বিজেপি কংগ্রেস বা সিপিএমেও নেই যেটা নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছিলেন। আর মনে রাখতে হবে লোকসভা নির্বাচন দেশের নির্বাচন, সেই নির্বাচনে একটা এলাকার ঘটনা তুলে আরও ৪১ টা আসনের ভোটার দের প্রভাবিত করা খুব মুস্কিল। এর পাশাপাশি ভোট প্রচারে যেমন সন্দেশখালি আসবে, একইভাবে লক্ষীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী র মতো সামাজিক সুরক্ষার ইস্যু বা ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রের বঞ্চনার ইস্যুও উঠে আসবে। তবে আবার বললাম সব নির্ভর করবে প্রশাসন ও সরকারও কতো দক্ষতার সাথে এই ইস্যু সামলাতে পারে তার ওপর।”