
ইন্দ্রানী চক্রবর্তী:মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে আরজিকর মামলার শুনানি চলাকালীন জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী মেডিকেল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টানেন। যদিও সুপ্রিম কোর্ট বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে এই বিষয়ে শীর্ষ আদালত ঢুকবে না। কিন্তু কবি গুরু বলেছেন, প্রশ্ন যখন আসে, তা একা আসে না। মেডিকেল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠতেই উঠছে অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গও। গত কয়েক বছর যাবৎ থমকে রয়েছে এ রাজ্যের বিভিন্ন এলিট-ননএলিট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। অথচ ছাত্র রাজনীতি সাংবিধানিক অধিকার, ছাত্র সংসদ নির্বাচন তো বটেই। শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বরা বলবেন, ‘কই! নির্বাচন তো হয়! এসব বিরোধীদের চক্রান্ত!’ এই প্রসঙ্গে নিজেদের রাজ্যের বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলির নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গ কী বলছেন দেখা যাক।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো বামপন্থী ছাত্র সংগঠন সারা ভারত ছাত্র ফেডারেশন (এআইএসএফ)-এর প্রাক্তন জাতীয় সভাপতি শুভম ব্যানার্জী বললেন, “ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের যে অধিকার তা ৪০-এর দশকে ছাত্ররা বৃটিশ সরকারের থেকে আদায় করে নিয়েছিল। তার আগে বৃটিশ আমলে তো স্টুডেন্ট ইলেকশন বলে কোনও জিনিস ছিল না। প্রথম ১৯৩৮ সালে ছাত্ররা ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে। তারপর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আন্দোলন গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বৃটিশরা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট অ্যামেন্ড করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অধিকার দিয়েছিল। সেই ৪০শের দশক থেকে টানা এই অধিকার ছাত্ররা পেয়ে এসেছে গোটা দেশে, এ রাজ্যে তো বটেই। সুতরাং এই অধিকারটা যে বিগত কয়েক বছর ধরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তা ক্যাম্পাসের মধ্যে একজন ছাত্রের যে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক অধিকার তার উপর আঘাত। যেটা বৃটিশ আমলে লড়াই করে পাওয়া অধিকার সেটাকে যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতেই হবে।”
ভারতের ছাত্র ফেডারেশন (এসএফআই) -এর সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য বললেন, “আমরা আমাদের সংগঠনের তরফ থেকে বহুদিন ধরে ছাত্র ভোট চেয়ে আসছি। বামপন্থী সরকার থাকাকালীন প্রতিবছর রাজ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হত। তৃণমূল সরকার আসার পর গত ১২ বছরে তিনবার বা চার বারের বেশি হয়নি। সেগুলোও একদম ছাত্র ভোটের নামে লুঠ হয়েছে প্র্যাক্টিকালি। এসএফআই নেতা সুদীপ্ত গুপ্ত এই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে তৃণমূল পুলিশের হাতে খুন হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে রাজ্যে ছাত্র ভোট বন্ধ আছে। মাঝে ২০১৯ সালে সম্ভবতঃ প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী, ডায়মন্ডহারবারে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ কলেজে এখন ৫৫বছর বয়সী তিন বাচ্চার বাপ নেতারা ঘাড়ের উপর বসে নেত্য করছে। কলেজের ইউনিয়নগুলোকে মধু ভান্ডার হিসেবে ধরে রেখে তারা গোটা টাকে দখল করার মানসিকতা নিয়ে চলছে। ছাত্র ভোট নাহলে স্টুডেন্ট এইড ফান্ড সহ ছাত্রদের কল্যাণমূলক কাজকর্ম থমকে থাকে। এই যে ছাত্র ভোট হচ্ছে না, টিএমসিপি কলেজের যে টাকা ছাত্রদের পাওয়ার কথা তা নিয়ে বেআইনিভাবে মোচ্ছব করে চলছে বছরের পর বছর ধরে। ফলে আমরা দীর্ঘদিন ছাত্র ভোটের দাবি জানাচ্ছি। আমি নিজে দুই শিক্ষা মন্ত্রীর সাথেই, মানে যিনি জেলে আছেন এবং যিনি জেলে যাবেন, মিটিং করেছি। দুজনেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ছাত্র ভোট হবে। কিন্তু এখনও হয়নি। এই মেডিকেল কলেজের দাবির সাথেই আমরা রাজ্যের সর্বত্র স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ছাত্র নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।”
অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)-র রাজ্য সম্পাদক ঋতম মাঝি জানাচ্ছেন, “গত নির্বাচনের পর থেকেই আমাদের কাছে এটা বড় প্রশ্ন। বহুদিন ধরেই আমরা দাবি জানিয়ে যাচ্ছি যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার প্রয়োজন আছে, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব স্তরে। এভাবে দীর্ঘদিন যদি কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হয় তবে মিনিমাম যে গণতান্ত্রিক পরিসর আছে তা শেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে ছাত্র ছাত্রীদের লড়াইয়ের বড় কেন্দ্র হচ্ছে এই ইউনিয়নগুলি। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র সংসদগুলির ঐতিহ্য রয়েছে জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রকে বাঁচানোর জন্য বড় বড় আন্দোলন সংঘটিত করার। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদগুলির বড় ভূমিকা রয়েছে। এই সময় আমরা দেখতে পাচ্ছি যখন সারা দেশ জুড়ে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টা চলছে তখন আমরা মনে করছি এই দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য ইউনিয়ন ইলেকশনের প্রয়োজন রয়েছে ভীষণভাবে। সেটার কোনভাবেই বেশি দিন আটকে রাখা যাবে না। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রযুবরা ছাত্র নির্বাচনের কথা বলছে এবং এটা নিয়ে আরও বড় আন্দোলন হবে বলে আমরা মনে করছি এবং সেই আন্দোলনে আপামর ছাত্র সমাজ থাকবে।”
প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস ফেডারেশান (পিডিএসএফ)-এর সদস্য শিল্পক বলছেন, ” বিষয়টা হল এখন ছাত্রদের মধ্যে মানে ইন জেনারেল স্টুডেন্টরা যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চায় এমনটা নয়। তার কারণ তারা ছাত্র সংসদ হিসেবে মূলত তৃণমূলকেই আইডেন্টিফাই করে। এবং সেখানে ব্যাপারটা গুন্ডামি, তোলাবাজি, কলেজে ইউনিয়নবাজি করা, এই গোটা ব্যাপারটা কি তারা ইউনিয়ন বলে মনে করে। এবং সেটা যে কোন কলেজ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের মধ্যে এ ধারণা রয়েছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক কর্মীদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে; কিন্তু যে কোন কলেজে স্টুডেন্টের কাছে, এমনকি যাদবপুরের ৭০ শতাংশ ছাত্রের বক্তব্য ‘এই ইউনিয়নটা না থাকলেই ভালো’। এরকম একটা কন্ডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মেডিকেল কলেজের যে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ তা আসলেই নির্বাচনের ব্যাপারটাকে থ্রো করেছে সাধারণের মধ্যে কিন্তু তা যে আম স্টুডেন্টদের কাছে অনেক বেশি একসেপটেবল হয়ে গেছে, এপার্ট ফ্রম পলিটিকাল পিপল, এমনটা নয়। আমরা তো চাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক কিন্তু যে লজিকে চাই জেনারেল স্টুডেন্টরা সেই লজিকের ধারে পাশেও নেই আসলে। একটা অন্যরকম বাস্তবতার দিকে তারা এগিয়ে রয়েছে। ফলে আমার বা আমাদের বক্তব্য যে ইউনিয়নের ও আগে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তৃণমূল বা স্বৈরাচার বিরোধী কোন স্টুডেন্ট বডি যদি তৈরি করা যায় যেটা হয়তো ইউনিয়ন নয় এক্ষুনি। ফলে ইউনিয়নের মতো জিনিসটাকে যদি আগামী দিনে লিজিটিমাইজ করাতে হয় তবে এমন একটা স্পেস দরকার যেখানে ছাত্রছাত্রীরা গলা তুলে কথা বলতে পারবে। না হলে কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যে দাবিটা সেটাকেও সেই অর্থে ফ্লোট করানো যাবে না বা সেটার কোনও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে না। এ প্রসঙ্গে কলকাতার এলিট ক্যাম্পাস এবং প্রেসিডেন্সি যাদবপুরের হালটাও খুব খারাপ। মেডিকেল রেয়ার এক্সেপশন কারণ, দুই বছর আগে মেডিকেলে এই নিয়ে একটা মুভমেন্ট হয়। সরকার কাছে দাবি ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচন শেষে সরকার না করতে দিলে একটি প্যারালাল নির্বাচন করায় ছাত্ররা। সেটাও আসলে এমসিডিএসএ-র মধ্যে দিয়েই ফ্লো করেছে। এমসিডিএস এর মধ্যেও এমন একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন আছে যারা সাধারণ ছাত্রদের গণতান্ত্রিক দাবিগুলোকে রিপ্রেজেন্ট করে। যাদবপুর প্রেসিডেন্সিতেও এটা একটা বড় সমস্যা। দীর্ঘদিন যদিও সেখানে এই পরিসর ছিল ফ্যাস ছিল ডিএসএফ ছিল এসএফআইও একরকম ভাবে করেছে কিন্তু, পোস্ট লক ডাউন পিরিয়ডে ছাত্রদের সাথে ক্যাম্পাসের বিচ্ছিন্নতা আসায় এই পরিসরটা প্রায় পুরোটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইউনিয়নের নামে ছাত্রদের একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে।”
এদিকে বাম ছাত্র সংগঠনগুলির বাইরে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ(সিপি)-র উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা সম্পাদক অনমিত্র নাগ বলছেন, “শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজগুলিতে নয় পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো সরকারি কলেজে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারটা পুরোটাই শাসক দলের হাতে থাকে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ সময় সবই সরকার নির্ধারণ করে দেয়। ২০১১ সালের পর থেকে আমার অন্তত মনে পড়ছে না পশ্চিমবঙ্গে কোন কলেজে ঠিকঠাক ছাত্র সংসদ নির্বাচনটা হয়েছে বলে। তাই কথা এটা একচেটিয়া ক্ষমতা বিস্তার করার একটা প্রচেষ্টা। এবং এই যে সর্বগ্রাসী একটা মনোভাব, মানে সব কিছু খাবো, সব নিয়ে বসে থাকবো এটা কখনো কোনও ডেমোক্রেসির রূপ হতে পারে না এটা ডিক্টেটারশিপ। ভোট বাক্সে ভোট লুঠ করা থেকে শুরু করে লোকসভা নির্বাচনের আগে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে থ্রেট করা টাকা পাম্প করা, এটাতো আমরা সংবাদমাধ্যম এবং রাস্তায় বেরিয়ে দেখতেই পাচ্ছি বহুদিন ধরে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনেরও একই হাল। ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও এরা আলাদা করে কিছু করবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের সব ক্ষেত্রে এদের একটাই মনোভাব সবকিছু থেকেই আমরা টাকা লুট করব। ভোটে পারবো কাউন্টে বাড়বো এই এদের প্রচেষ্টা। ছাত্র জীবনকে একটি নতুন মাত্রা দেওয়া, সর্বোপরি ছাত্র জীবন নিয়ে এদের কোন ফ্যান্টাসিই নেই। সেটার জন্য শিক্ষা লাগে।”
প্রসঙ্গতঃ, আরজিকর আন্দোলন শুরুর লগ্নেই একটি শব্দবন্ধ উঠে এসেছে যা হল ‘থ্রেট কালচার’। এই ‘থ্রেট কালচার’ চালানোর অভিযোগ বারবার উঠেছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ এই একই বিষয়কে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে। দীর্ঘদিনের ছাত্র আন্দোলনকারীরাও বলছেন ছাত্র ভোটের গণতান্ত্রিক পরিসর ছাড়া এই থ্রেট কালচার মেটানো না মুমকিন।