
কুশল চক্রবর্তী
এবার রিসার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সরকার বাহাদুরকে গতবছরের থেকে আরও ৫৭ হাজার কোটি টাকা বেশী দিতে যাচ্ছে। অর্থাৎ কিনা ২০২৩-২৪ এর বছর শেষে তারা তাদের লাভের থেকে সরকারকে দিয়েছিল ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। এবার দিল ২.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে যা কিনা ২৭% বেশী। অবশ্যই এই টাকাটা এল তাদের ২০২৪-২৫ বছরের লাভ থেকে। গতবছর থেকে এবার বেশী লাভের কথা অনেক দিন থেকেই আশা করা যাচ্ছিল। হলও তাই। কেন্দ্রীয় সরকার বা ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে বিষয়টা হয়ত ভালই। কিন্তু রিসার্ভ
ব্যাংকের লাভটা যেভাবে এল তা নিয়ে কিন্তু কিছু প্রশ্নের ব্যাপার থেকেই গেলো।
২০১৮-১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জালান কমিটি বসিয়ে রিসার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে কত টাকা কেন্দ্রীয় সরকার পেতে পারে, সে ব্যাপার সিলমোহর দেবার পর থেকে রিসার্ভ ব্যাংকের মধ্যেও যেন একটা তাগিদ দেখা দিয়েছিল সরকারকে আরও বেশী টাকা দেবার ব্যাপারে। কোভিডকালে, মানে ২০২০-২০২১, ৩০৩০৭ কোটি টাকা পাওয়া ছাড়া, এখনকার কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৩-১৪ সময়ের কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে অনেক বেশী টাকাই পাচ্ছিল। এতে সরকারের একটা সুবিধা হচ্ছিল যে বাজেটে আয় বায়ের যে ঘাটতি থাকছিল তা অনেকটাই মেটানো যাচ্ছিল। কিন্তু যে দেশে সরকারি কোষাগারের খরচ নিয়ে সরকারি লোকেদেরই প্রশ্ন থেকে যায়, সেখানে আয়ের পরিধি বাড়লেও চিন্তা থেকেই যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই টাকা রিসার্ভ ব্যাঙ্ক দিচ্ছে কিভাবে ! রিসার্ভ ব্যাংকের লাভের একটা ভালো অংশ আসে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের মধ্যে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন তার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন ভারতীয় মুদ্রায় ডলারের দাম ছিল ৬০ টাকা। এখন তা এসে দাঁড়িয়েছে ৮৩ থেকে ৮৪ টাকায়। শুধু তাই নয় সারা বছর ধরে চলেছে ডলালের দামের ওঠা পড়া। এতে প্রায়শই মাঠে নামতে হয়েছে রিসার্ভ ব্যাঙ্ককে। ডলার বিক্রি করে বা কিনে ডলারের বাজারকে নিয়ন্ত্রন করতে হচ্ছে। এই যে ডলার বিক্রি করা বা কেনা এর মধ্যেই নিহিত আছে রিসার্ভ ব্যাংকের লাভ লোকসানের একটা বড় অংশ। রিসার্ভ ব্যাঙ্ক বা তার হয়ে কোন ব্যাঙ্ক যখন ডলার কোন বাক্তির কাছ থেকে বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনে, তার যে দাম হয়, ডলার বিক্রি করার দাম হয় সবসময় তার থেকে বেশী। আর এই দামের তারতম্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে রিসার্ভ ব্যাংকের লাভের গল্প। খুব সোজা ভাষায় বলা যায় যে রিসার্ভ ব্যাঙ্ক ডলার কেনে কম দামে আর বিক্রি করে বেশী দামে। এর ফলেই আসে তার লাভ। কিন্তু এই যে ডলারের দামের ওঠা নামা, তাতে মুশকিলে পড়তে হয় ছোট বা মাঝারি ব্যবসায়িদের আর কোন কোন ক্ষেত্রে বিদেশে পরতে যাওয়া সাধারন ছাত্রদের। এমনকি ডলারের তুলনায় দেশের টাকার দামের অবমূল্যায়ন হলে তার প্রভাব পড়ে শেয়ার বাজারেও।
যে সব কোম্পানি আমদানি রফতানিতে নিয়োজিত তাদের নানা সমস্যার সন্মুখিন হতে হয় ডলারের দামের ওঠা নামার জন্য। এখন তো ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের অনেকটাই দাড়িয়ে আছে আইটি কোম্পানি গুলোর ব্যবসা বাণিজ্যের উপর, তাদের কাছে তো ডলারের দামের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এই “অস্থির” বাজার সুস্থির করতে গিয়ে লাভ হয় রিসার্ভ ব্যাংকের। অন্যদিকে রিসার্ভ ব্যাঙ্ক হচ্ছে ব্যাংকার’স ব্যাঙ্ক। দেশের সারা ব্যাংকিং বাবস্থা তারাই নিয়ন্ত্রন করে। ইদানীং তারা ব্যাঙ্ক বাবস্থা ঠিক করার নামে, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক গুলোর উপর একের পর এক আর্থিক জরিমানার খাঁড়া নামিয়ে এনেছে। এবং এই জরিমানার পরিমাণটা এমন যে ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তারা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর উপর আর্থিক জরিমানা হিসাবে ৭৮.৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। যা কিনা বিগত বছরের চেয়ে ৮৮.৬ শতাংশ বেশী। হয়তো ব্যাঙ্ক
বাবস্থা আরও বেশী ত্রুটিহীন করতে এর কিছুটা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় এই জরিমানার পরিমানের ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে গেছে। যেমন কোন কারেন্সি চেস্ট ব্যাঙ্ক ৭টার মধ্যে তাদের চেস্টের টাকার হিসাব রিসার্ভ ব্যাংকে পাঠাতে না পারলে ৫০০০০ টাকা জরিমানা বা কেওআইসি ত্রুটির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমান করা, এ সবই অবাক করেছে ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে জড়িত থাকা কর্মীদের।
এ ছাড়াও আছে ব্যাংকের ছোট ছোট ভুলের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর উপর নানা জরিমানা আদায় করার প্রবনতা। ব্যাঙ্ক বাবস্থা উন্নত করার জন্য রিসার্ভ ব্যাঙ্ক যে পরিমান পরিকল্পনার কথা বলে, সেই পরিমান পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার মত লোক বাণিজ্যিক ব্যাংকের আছে
কিনা তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় বলে মনে হয় কি ? পরিশেষে একটাই কথা বলা যায়, যে কোন রাষ্ট্রীয় সংস্থার লাভের বাড়বাড়ন্ত অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে, কিন্তু সেই লাভের তুলে আনার প্রক্রিয়া বা তার সঠিক প্রয়োগের দিকে নজর রাখা কি উচিত নয় ?