
শান্তনু পান : এক সময় যে মেয়েটি চুপ করে থাকত। কারও চোখে চোখ তুলে তাকাত না। কথার তো প্রশ্নই ওঠে না — সেই শ্রেয়া সাহা আজ মঞ্চে উঠে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গলা খুলে কবিতা বলছে। তার এই রূপান্তরের নেপথ্যে আছে বালুরঘাটের এক ছোট্ট আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র— ‘আবৃত্তাঙ্গন’ এবং তার প্রতিষ্ঠাতা বর্ণালী সরকার ঘোষের অদম্য উদ্যোগ।
করোনার কঠিন সময়ে আচমকা কথা বলা বন্ধ করে দেয় শ্রেয়া। বুঝে উঠতে পারেননি বাবা সন্দ্বীপ সাহা ও মা প্রিয়াঙ্কা সাহা। পরে কলকাতার এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জানান, শ্রেয়া মাইল্ড অটিজমে আক্রান্ত। চিকিৎসক স্পিচ থেরাপির পরামর্শ দেন। কিন্তু বালুরঘাট থেকে কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত করে থেরাপি করানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এই দিশেহারা সময়েই আলোর দিশা দেখায় ‘আবৃত্তাঙ্গন’। বর্ণালী দেবী শুধু আবৃত্তি শেখান না, কবিতার ছন্দকে ব্যবহার করেন মন বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে। তিন মাস আগে শ্রেয়াকে সেখানে ভর্তি করা হয়। কঠিন কোনও ওষুধ নয়, কঠিন পরিবেশ নয় — কবিতার শব্দ, ছন্দ ও ভালবাসা দিয়ে শুরু হয় শ্রেয়ার চিকিৎসা। ফলাফলও মেলে হাতে-নাতে। যেই শ্রেয়া একসময় কথা বলত না, সে আজ নির্দ্বিধায় মঞ্চে উঠে কবিতা পাঠ করে। সম্প্রতি ‘নাট্যতীর্থ মন্মথ মঞ্চে’ আয়োজিত ‘আবৃত্তাঙ্গন’-এর বার্ষিক অনুষ্ঠানে শ্রেয়ার আবৃত্তি শুনে দর্শকরা বিস্ময়ে অভিভূত। আবেগে কাঁদলেন শ্রেয়ার মা, “ভাবতেই পারিনি আমার মেয়ে আবার কথা বলবে, আবার কবিতা বলবে ! এটা স্বপ্নের মতো। বর্ণালী ম্যাডামের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।”
শুধু শ্রেয়া নয়, আরও অনেক শিশুর জীবনেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এনে দিয়েছে ‘আবৃত্তাঙ্গন’। যাঁরা আগে কথা বলতে সাহস পেত না, আজ তাঁরা শ্রুতি নাটকে অংশ নিচ্ছে, কবিতা পাঠ করছে। বর্ণালী সরকার ঘোষ বললেন, “ওরা যখন নিজের কণ্ঠে কবিতা বলে ওঠে, তখন মনে হয় আমার এই পথচলা সার্থক।”
বালুরঘাটের মতো ছোট শহরে এমন একটি প্রয়াস নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক। শ্রেয়ার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় — সঠিক সাহচর্য, ধৈর্য এবং ভালোবাসা থাকলে, থেমে যাওয়া কণ্ঠস্বরও গেয়ে ওঠে নতুন জীবনের গান।